জেলা

অনুষ্টুপ তোর ‘পায়ে পাথর বাঁধা, ঠোঁটের উপর খোদাই’ “আলবিদা”…

ঠিক যখনই ভীষণ এলোমেলো
হঠাৎ দেখি পাহাড়-খিদে পেল।

গুছিয়ে খাব ইচ্ছে হল বিরাট
কিন্তু তোমার ভীষণ শিরঃপীড়া…

নাকের পাটা লাল হল খুব দ্রুত…
জ্বর আনা চাই। স্নানের দেরি ছুতো…

এটাই ছিল তরুণ কবি অনুষ্টুপ পালের শেষ কবিতার কয়েকটি লাইন। গুয়াহাটি বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ৩৩ ছুঁইছুঁই কবি। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। তারপর মালদা, সেখান থেকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ। অবস্থার ক্রমশ অবনতি হলে কলকাতার কোঠারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তরুণ কবিকে। শুরু হয় নতুন এক জীবন যুদ্ধ। হাজার হাজার মানুষ কবির চিকিৎসার খরচ জোগাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয় কবি। বাড়ি ফিরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই আবার অসুস্থতা বোধ করলে নিয়ে যাওয়া হয় হায়দ্রাবাদে। মূলত প্যানক্রিয়াসের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হলেও কয়েকদিন আগেই ধরা পড়ে ক্যান্সার। শুক্রবার ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ জরুরীভিত্তিতে ডায়ালিসিস করতে হয়। রুগ্ন শরীরে এতটা চাপ নিতে পারেনি অনুষ্টুপ। সকাল ছটা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। অনুষ্টুপ কবি বলে পরিচিত হলেও পেশাতে সে ছিল একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বেতনের বেশির ভাগই চলে যেত দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার খরচে। বাউন্ডুলে কবি ছুটি পেলেই পুরুলিয়ার জঙ্গল থেকে পাহাড়ে ছুটে বেড়াতেন প্রকৃতির টানে। কবির মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই শোকের ছায়া নামে তার গ্রামের বাড়িতে। পাশাপাশি শোক প্রকাশ করেন অগণিত মানুষ। শুক্রবার গভীর রাতে কবির গ্রামের বাড়িতে তার দেহ আনা হয়। বহু মানুষ হাজির হয় কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে। শনিবার সকালে কফিনবন্দি দেহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়। পরিসমাপ্তি ঘটে এক তরুণ শিক্ষক, কবির, অসমাপ্ত জীবনের।

অনুষ্টুপ এর ফেসবুক ওয়াল, নোটপ্যাড বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকশো অপ্রকাশিত কবিতা।যা এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। অনুষ্টুপের বেশ কিছু কাছের মানুষ মিলে আরামবাগ গ্রন্থমেলায় কয়েকদিনের মধ্যেই অনুষ্টুপ এর লেখা নিয়ে প্রকাশ করতে চলেছে অনুষ্টুপ এর নতুন বই” ভুল বই না “। অনুষ্টুপ এর কবিতার মধ্যেই আগামী দিন বেঁচে থাকবে এক তরুণ কবি, এক ছাত্রদরদী শিক্ষক, এক অকৃপণ হৃদয়ের বন্ধু। আর হয়তো অনুষ্টুপের মতো করে কেউ অসহায় মানুষগুলোকে আপন করে নেবে না। হয়তো তার মতো করে কেউ ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা কোনও দুঃস্থ মানুষের গায়ে স্নেহের চাদর জড়িয়ে দেবে না। বিশ্বাস, ভরসার হাত বাড়িয়ে দেবে না। অনুষ্টুপ নেই, রয়ে গেছে তার অসংখ্য লেখা। অনুষ্টুপ নেই রয়ে গেছে তার বন্ধুবান্ধব, তার আত্মার আত্মীয়রা।

অনুষ্টুপ নেই, রয়ে গেছে তার অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। আর ওই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেঁচে রয়েছে তাদের ‘মাষ্টার দা’। এদের মধ্যেই বেঁচে থাকবে অনুষ্টুপের অসংখ্য লেখা। আর এই লেখাটাই বাঁচিয়ে রাখবে অনুষ্টুপকে। এক তরুণ কবিকে। এক সৃজনশীল শিক্ষককে। এক বন্ধুকে। আজ বাংলার পক্ষ থেকে তরুণ কবিকে গভীর শ্রদ্ধা, বুক ভরা ভালোবাসা। শুধু একটাই কথা বলার, কবি তুমি যেখানেই থেকো ভালো থেকো। তোমাকে আমরা ভুল বই-না।

Loading

Leave a Reply