আরামবাগ : আমবারুণীর দিনেই দীঘির জলে অন্তর্ধান হয়ে যান মা দুর্গা। তারপর থেকেই আরামবাগের এই এলাকায় গড়বাড়ির রাজা রণজিৎ রায়ের খনন করা দীঘির পাড়ে বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসছে তথাকথিত দীঘির মেলা ও মা দুর্গার পূজার্চনা। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন দীঘির জলে স্নান করে পূণ্য লাভ করতে, পাশাপশি এই মেলার বিখ্যাত পাকা কাঁচকলা মাখা মুড়ি খেতে।
আনুমানিক ৪০০ বছরের ঐতিহাসিক গল্প-গাথায় জড়িয়ে থাকা দীঘির মেলা শুরু হল বৃহস্পতিবার থেকে। গড়বাড়ির রাজা রণজিৎ রায়ের খনন করা দিঘির পাড়ে আমবারুণী উপলক্ষে এই মেলা বসে। প্রাচীন রীতি মেনে আজও আরামবাগের ডিহিবায়রা এলাকায় মহা সমারোহে শুরু হল বহুল প্রতীক্ষিত এই মেলা। প্রায় দশদিন ধরে চলবে এই মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক ভক্ত এসে দীঘিতে স্নান করে পাশেই থাকা দেবী দুর্গা মন্দিরে পুজো দেন। পাশাপশি গৃহস্থালির সরঞ্জাম কিনে বাড়িতে ফেরেন ভক্তগণ।
কথিত আছে, গড়বাড়ির রাজা রণজিৎ রায়ের শিশু কন্যা আমবারুণীর দিন ওই দিঘিতে ডুবে মারা যায়। ডুবে যাওয়ার আগে সে এক শাঁখারির কাছে শাঁখা পরে। ওই শাঁখারি রাজাকে রাজকন্যার দিঘির জলে অন্তর্ধানের খবর দিয়ে শাঁখার দাম চান। রাজা দিঘির কাছে মেয়েকে হাঁক দিয়ে ডেকে, সে কেমন শাঁখা পরেছে দেখতে চান। তখন শাঁখা পরা হাত দু’টি জলের উপরে দেখা যায় বলে কথিত আছে। সেই শাঁখা পরা হাত দেখতে এতই ভিড় হয় যে, সেদিন থেকেই মেলা চালু হয়। তখন থেকেই আমবারুণীর দিন ওই দিঘিতে স্নানের রেওয়াজ চালু হয়। রায় পরিবার বংশপরম্পরায় শুনে এসেছেন— এই দিঘি খনন হয় মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে। দলিলে দিঘিটির জল এলাকা ১২ একর ৭২ শতক। চারদিকের পাড় এলাকা ১২ একর ৮৪ শতক জায়গা নিয়ে। বছর ত্রিশ আগে অবধি পুকুরের চার পাড় জুড়ে এই মেলা বসলেও এখন দিঘির এক পাড়ে, রাজ্য সড়কের দুই ধারে এবং দিঘি সংলগ্ন মাঠে মেলা বসে। এই মেলা করার জন্য জেলা পরিষদের অনুমতি নেওয়া হয়। পুলিশ ক্যাম্পেরও দাবি জানানো হয়।
দিঘির মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল— পাকা কাঁচকলা মুড়িতে মাখিয়ে খাওয়া। এছাড়া এই মেলাতে দেখা যায় হাত পাখা, ময়না-টিয়া সহ নানা পাখি, মুদিখানার যাবতীয় সরঞ্জাম, পাকা কাঁচকলা, জিলিপি, মাদুর, ফলুই, কাঠের দরজা-জানালা-খাট ইত্যাদি। এছাড়া এই মেলার বিখ্যাত লাঙ্গল, জোয়াল, গরুর গাড়ির চাকা, নানা ধরনের মিস্ত্রিদের যন্ত্রপাতি, কাচের চুড়ি, কড়াই ইত্যাদি বিক্রি হয়। তার পাশাপাশি মেলা থেকে সারা বছরের মুদিখানার শুকনো লঙ্কা, গোটা হলুদ, জিরে, ধনে, পোস্ত, ডাল ও কলাই কিনেতে আসেন বহু মানুষ।
তবে ক্রমেই জৌলুস হারাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী রায়দীঘির মেলা। একসময় দিঘির মেলায় মূলত পাকা কাঁচকলা বিক্রি হতো, যা আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এই মেলাকে যথাযথ টিকিয়ে রাখার জন্য জেলা পরিষদের কাছে আবেদন করেছে মেলা কমিটি। তবে বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, আপাতত প্রাচীন এই মেলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে শাঁখা-সিঁদুর ব্যবসা।