গোপাল মিস্ত্রি
ভালোদাদু ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে পাঠকমহলে। তবু সাময়িক বিরতি। পুজোর পর একেবারে নতুন গল্পের হাত ধরে ফিরলেন তিনি। পড়ুন গোপাল মিস্ত্রির নতুন গল্প ‘পরিযায়ীর পঁচিশে বৈশাখ’।
বাড়ি যাব বলে কতদিন ধরে হেঁটেছি ঠিক হিসেব নেই। কিন্তু পৌঁছতে পারলাম না। বাড়ির কাছে এসে আটকে গেলাম। সরকারিবাবুরা এইমাত্র, এই সন্ধ্যাবেলায় আমাকে এবং আরও কয়েকজনকে একটা বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। এখানে আগে থেকে যারা ছিল তারা বলল, এটা সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার।
মোবাইলে চার্জ ছিল না বলে ক’দিন ধরে বাড়ির কোনও খবর জানি না। তাড়াতাড়ি চার্জে বসিয়েই শ্যামলীকে ফোন করলাম। শ্যামলী বলল, মায়ের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। অপারেশেন করতে হবে। কিন্তু ডাক্তার বলেছে করোনার জন্য এখন আর অপারেশন হবে না। হাসপাতাল থেকে ক’দিন আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি জানতে পারিনি। আমি বললাম, আমাদের সবাইকে তো এখানে আটকে দিল। সরকারি কোয়ারেন্টাইনে এইমাত্র ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি বাড়ি যাব কী করে? বলছে চোদ্দো দিন থাকতে হবে। তারপর যদি সুস্থ থাকি তবে ছাড়া পাব।
শ্যামলী খুব কাঁদল। বলল, ঘরে একটাও টাকা নেই। জমানো যা ছিল মায়ের ওষুধপাতি কিনতে সব শেষ। এরমধ্যে রেশনের চাল পেয়েছে। কারা যেন একবার ত্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু আর কিছু নেই। আমিও তো টাকা পাঠাতে পারিনি। শ্যামলী ঘরের চালে লাউগাছ তুলেছিল। এখন শুধু লাউপাতা সেদ্ধ ভাত খাচ্ছে। অসুস্থ মাকেও ভালো কিছু খেতে দিতে পারছে না। ফোন ধরে মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদল। বাবাও কাঁদল। মা হয়তো বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখের জল ফেলল। আমি জানতে পারলাম না। আমারও বুক ভেঙে কান্না এল। কিন্তু আমি কাঁদতে পারলাম না। তাহলে ওরা যে আরও বেশি করে কাঁদবে। আমি ফোন ছেড়ে দিলাম।
আমরা অনেক মানুষ এই বাড়িটাতে। ক’দিন ধরেই নাকি এখানে এনে রাখা হচ্ছে। সবাই আমার মতো পরিযায়ী শ্রমিক। এতদিন তো কথাটা তেমনভাবে শুনিনি। তাই মানেও ঠিক জানি না। পরিযায়ী। তবে আমাদের অঞ্চলে বড় বিলে ফি বছর শীতকালে হাজার হাজার পাখি আসত সেই সাইবেরিয়া থেকে। তখন সবাই বলত, ওরা পরিযায়ী পাখি। কিন্তু শব্দটার ঠিক মানে জানতাম না। তবু বুঝে নিতাম ওরা সাইবেরিয়া থেকে আসে বলে ওদের পরিযায়ী পাখি বলে। তখন থেকে জানতাম পরিযায়ী পাখি হয়। এখন শুনছি পরিযায়ী শ্রমিকও হয়। আমি এবং আমরা সবাই।
ওরাও অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছে। কেউ যাবে বিহারে, কেউ ঝাড়খণ্ডে। যেমন আমি যাব নদীয়ায়। এখন আমরা সবাই এক ঠাঁই। কিন্তু কেউ কাউকে চিনি না। আলাপ হল। আমি নতুন এলাম বলে আমার কথা শুনতে চাইল।
আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি। মহারাষ্ট্রে গিয়েছিলাম একটু বেশি মজুরি পাওয়া যায় বলে। আমি তো এখানেই কাজ করছিলাম। কিন্তু ঠিক কুলোতে পারছিলাম না। যা পেতাম তাতে পেটের ভাত জোটাতেই হিমশিম খেতাম। আমার বাবাও মুনিষ ছিল। পরে ভ্যান টানত। দিনের রোজগারে চার পাঁচজনের সংসার চালানো যে কী কঠিন সে তো আমাদের চেয়ে বেশি কেউ ভালো জানে না। তাই ছোটবেলা থেকেই আর লেখাপড়া শেখা হয়ে ওঠেনি। টেনেটুনে সিক্স অবধি পড়েছিলাম। পরের ক্লাসে উঠতে পারিনি। তারপর বাবার মতোই কাজে লেগে গেলাম।
প্রথমে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। ইটবালি পাথর মাথায় বইতাম। মশলা মেখে রাজমিস্ত্রির হাতের কাছে এগিয়ে দিতোম। সেই তেরো চোদ্দ বছর বয়স থেকেই লেবারের কাজ শুরু। প্রথম প্রথম হাফ মজুরি পেতাম। অনেকদিন করার পর আমার মজুরিটা পুরো হয়েছিল।
তখন আমার কী আনন্দ। পুরো মজুরি পাচ্ছি। তখনই মাথার মধ্যে একটা স্বপ্ন গেঁড়ে বসল। আমাকে রাজমিস্ত্রি হতে হবে। কারণ ওদের মজুরি লেবারদের চেয়ে বেশি। সেই অল্প বয়স থেকে কর্ণিক নিয়ে একটু মশলা দিয়ে ইঁট বসাতাম। প্রথম প্রথম কর্ণিক ধরতে দিত না ওরা। তাও ধরতাম। বকা খেতাম। আবার ধরতাম। তারপর হেডমিস্ত্রি নিজেই বলত, তোর ইচ্ছে আছে, দু’খানা ইঁট গাঁথতো। ওইখানে একটু ধারটা মেরে দে। একটু মশলা লাগা। এই করতে করতে আমি ইঁট গাঁথা, প্লাস্টার করা, পাটা পেটানো, ঢালাই দেওয়া শিখলাম।
একজন ঠিকেদারের টিমে কাজে ঢুকলাম। একদিন তাকে বললাম, আমি তো এখন ভালোই পারি। আমাকে কি মিস্ত্রির কাজ দেবে?
আমার স্বপ্ন তো ওইটুকুই। আমি তো আর রাজপুত্তুর নই। বড়লোকের ছেলেও নই। বা সিনেমার নায়কদের মতোও নই। আমার স্বপ্ন রাজমিস্ত্রি হওয়া। ঠিকেদার বলল, ঠিক আছে করবি, কিন্তু এখন পুরো মজুরি পাবি না। তাই সই। লেবারের চেয়ে তো বেশি পাব। আমাকে রাজমিস্ত্রির কাজ দিল। আমিও একটু বেশি মজুরি পেতে শুরু করলাম। আমার আনন্দ আর ধরে না। অনেকদিন কাজ করে বেশ পোক্ত হওয়ার পর আমিও পুরো মজুরি পেতে শুরু করলাম। আমার স্বপ্ন দেখাটা আরও একটু বাড়তে লাগল।
তখন বাবার আর আমার রোজগারে ভালোই চলতে লাগল। এবার নতুন স্বপ্ন। আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি, লোকের পাকাবাড়ি বানাই। অথচ থাকি মাটির ঘরে। স্বপ্ন দেখতে লাগলাম কেমন করে একটা ইটের দেওয়াল তোলা ঘর তুলব। ছাদ না দিতে পারি অ্যাসবেসটাস লাগাব। পরে না হয় ছাদ দেব।
কিন্তু আমাদের স্বপ্ন তো সঙ্গে সঙ্গে পূরণ হয়ে যায় না। ইটের দেওয়াল তুলে বাড়ি করার স্বপ্ন দেখছি। একটু একটু করে জোগাড়ও করছি। ঠিক তখনই মায়ের অসুখ করল। হাসপাতালে দেখালাম। ডাক্তার বলে দিল হার্টের রোগ। চিকিৎসায় অনেক টাকা দরকার। পড়লাম অথৈ জলে, এত টাকা কোথাও পাব?
ঠিক তখনই অনেকে পরামর্শ দিল, দক্ষিণে চলে যা, সেখানে মজুরি বেশি পাবি। বাবা মাকে বললাম। মা প্রথমে রাজি হয়নি। বলল, ‘অতদূরে চলে যাবি বিনয়, কবে আসতে পারবি তার ঠিক থাকবে না।’ মা কান্নাকাটিও জুড়ল। কিন্তু পরে রাজি হল মজুরি বেশি পাব শুনে।
একদিন সত্যি সত্যি অসুস্থ মা, বাবা আর বোনকে রেখে এক ঠিকেদারের হাত ধরে চলে গেলাম মাহারাষ্ট্রে। গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো, একই কাজ করে এখানে যে মজুরি পেতাম ওখানে তারচেয়ে বেশি মজুরি। এখানে আর ওখানে মজুরির এত তফাত কেন বুঝতে পারলাম না। খরচখরচা করেও যে টাকা থাকত তা এখানকার মজুরির চেয়েও অনেক বেশি। বাড়িতে পাঠাতে লাগলাম সেই টাকা। এখানে সংসার চালানো, মায়ের চিকিৎসার পরও কিছু টাকা জমতে লাগল।
বছর দুয়েক ঘুরতেই ঘরের কাজে হাত দিলাম। ছুটি নিয়ে এসে নিজে হাতে ইটের দেওয়াল তুলে দু’খানা অ্যাসবেসটসের ঘরও তুললাম। বাবা মা বলল, এবার বিয়ে কর। দেখতে দেখতে বিয়েটাও হয়ে গেল। একবার ভেবেছিলাম, শ্যামলীকে নিয়ে যাব। কিন্তু দু’টো আলাদা সংসার হলে খরচ বেড়ে যাওয়ার ভয়। তাছাড়া আমরা তো এক জায়গায় পড়ে থাকি না। একটা কাজ শেষ হলে অন্য সাইটে চলে যাই। তাই আর নিয়ে যাইনি। আমি তখন ওখানে, আমার একটা মেয়ে হল। মেয়েকে প্রথম দেখি তখন ওর চার মাস বয়স। এরপর বোনেরও বিয়ে দিয়েছি গ্রামেই। ছেলেটাও আমারই মতো মহারাষ্ট্রে থাকে। বছরে দু’বার ছুটি নিয়ে বাড়ি আসি।
এবারও মাসখানেক বাড়িতে থাকব বলে ঠিক করেছিলাম। ট্রেনের টিকিটও কেটেছিলাম তিনমাস আগে। তখন তো কিছুই নেই। চীনে করোনা হয়েছে বলে শুনতাম একটু একটু। তারপর শুনলাম আমাদের দেশেও নাকি করোনা হয়েছে। সবাই আলোচনা করত। সেটা কী জিনিস জানি না। আমরা লেবার মানুষ, সারাদিন খেটে খাই। আমাদের কি আর অতশত খোঁজ নিলে চলে? বরং আমি খুব আনন্দে ছিলাম, বাড়ি আসার সময় এগিয়ে আসছিল বলে। আমার মেয়ের যে পাঁচ বছরের জন্মদিন এবার। শ্যামলী বলেছিল, কোনওদিন তো করিনি কিছু। এবার মেয়েটার পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন করব। আমাদের আত্মীয়স্বজন আর গ্রামে কয়েকটা বাচ্চাকে বলবে। একটা নতুন জামা হবে, একটু বেলুন দিয়ে সাজাবে আমাদের ছাপড়া ঘর। সে জন্য কিছু টাকাও আলাদা করে জমিয়েছে শ্যামলী।
মেয়েটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমাদের। শ্যামলী বলে, ‘আমার মতো মুখ্যু করে রাখব না মেয়েকে। আমার মতো অল্প বয়সে ওর বিয়েও দেব না। এখন থেকে ইস্কুলে যাবে। বড় হয়ে ও সবুজসাথীর সাইকেল পাবে, কন্যাশ্রীর টাকা পাবে। আরও অনেক লেখাপড়া শেখাব মেয়েকে।’ সেজন্য আমাদের গঞ্জে একটা কেজি ইস্কুলে মেয়েকে ভর্তিও করে দিয়েছে শ্যামলী। সামনের বছর ক্লাস ওয়ানে উঠবে।
মেয়ের সাথে আমার মোবাইলে কথা হতো। খালি বলত ‘বাবা তুমি বাড়ি চইলে আসো। এখেনে কাজ করবা।’ আমি বোঝাতাম এই তো তোর জন্মদিনে আসব মা।
মেয়ে জিজ্ঞেস করত, আমার জন্য কী আনবা বাবা?
আমি বলতাম, তুই কী নিবি বল?
মেয়ে বলত, একটা বড় পুতুল নিয়ে আসবা। যেমন টিভিতে দেখি, জন্মদিনে কেমন বড় বড় পুতুল দেয়, ওই রকম।
আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে মা তোর জন্য ওইরকম বড় একটা পুতুল নিয়া আসব।
আমার মেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। ঘরের কোথায় সাজিয়ে রাখবে তাও বলত আমাকে।
হঠাৎ শুনলাম একদিন নাকি জনতা কার্ফু হবে। আমাদের ঠিকেদার বলল, সেদিন কাজ হবে না। আমরা গা করিনি, একদিন কাজ হবে না তো কী হয়েছে! সেদিন আমরা বেশ জমিয়ে মাংসটাংস রান্না করে খেয়েছিলাম সবাই মিলে। পরের দিন আমাদের কাজ হল। কিন্তু তারপর হঠাৎ শুনি লকডাউন হয়ে গেল। লকডাউন মানে কী? এরকম কথা তো আগে কোনওদিন শুনিনি। তবে বুঝতে পারলাম। আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। ঠিকেদার বলে দিল, ঘরের বাইরে যাবে না। আমরা ঘরে বন্দি হয়ে গেলাম। বাইরে বেরনো বন্ধ, দোকান বাজার বন্ধ, কাজ বন্ধ, রোজগার বন্ধ। প্রথম প্রথম ক’দিন খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তারপর খাবার পাই না। শুনে বাড়িতে সবাই চিন্তায় পড়ল। মা বলল, বিনয় তুই যেভাবে পারিস বাড়ি চইলে আয়। আমি বললাম, একুশ দিন পর তো আবার সব ঠিক হইয়ে যাবে। ভয় কী মা? আমি ঠিক সময়ে যাব।
আমাদের চলছিল না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে। একদিন শ্যামলী ফোন করে বলল, মার খুব অবস্থা খারাপ। গাড়ি বন্ধ। বাবা ভ্যানে করে মা আর শ্যামলীকে নিয়ে ব্লক হাসপাতালে নিয়ে গেছিল, ডাক্তার মাকে সদরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছে। বাবা প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার ভ্যান টেনে মাকে সদরের হাসপাতালে নিয়ে গেছে। গ্রামে বোনের বাড়িতে আমার মেয়েটাকে রেখে শ্যামলীও মায়ের কাছে।
কী হবে এবার? আমি কেবল ভগবানকে ডাকতে লাগলাম। কী করে সব সামাল দেবে আমার বউ? মনে মনে ঠিক করলাম লকডাউন উঠে গেলেই নতুন করে ট্রেনের টিকিট কেটে বাড়ি চলে যাব। কিন্তু উঠল না। আবার বেড়ে গেলে লকডাউন। এবার যেদিন শেষ হবে সেদিনই আমার ট্রেন। তার ক’দিন পর আমার মেয়ের পাঁচ বছরের জন্মদিন। কোনওবার তো মেয়ের জন্মদিনে বাড়িতে থাকি না। এবার থাকব ঠিক করেছিলাম। ওদিকে মা হাসপাতালে। আমি আটকে মহারাষ্ট্রে। আমাদের আর খাবার জুটছিল না। আমরা বাইরের লোক বলে এখানে কেউ সাহায্য করছে। আর রোজই শ্যামলী ফোন করে বলছে, মায়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
তখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। শুনতে পাচ্ছি, এরপর আবার নাকি লকডাউন বাড়বে। তাহলে বাড়ি ফিরব কী করে? কত মানুষ তো আগেই হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। টিভিতে দেখাচ্ছে। সে তো কাছাকাছি, পাঁচ সাতশো মাইল হবে। কিন্তু আমাদের বাড়ি তো হাজার হাজার মাইল।
আমি অধীর হয়ে উঠেছি। মা হাসপাতালে, আমার মেয়ের জন্মদিন। আমি যদি এখানে এই ভাবে বন্দি হয়ে পড়ে থাকি, তাহলে চলবে কী করে? মজুরি পাইনি। সবারই হাত খালি। সঙ্গীদের বললাম। ওরাও যেতে চায়। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে ঠিক করলাম, পরদিনই হাঁটা শুরু করব। হেঁটেই দেশের বাড়িতে ফিরে যাব। ফোন করে শ্যামলীকে বললাম। মেয়েকে আমি কথা দিলাম, ওর জন্মদিনের আগেই আমি বাড়ি পৌঁছব।
আমি, বিশু, বাবলু, মুস্তাক, রফিকুল, সাজ্জাদ, সুব্রত, আমরা সবাই পরের দিনই ভোর থেকে হাঁটা শুরু করলাম। আমার পিঠে একটা ব্যাগে আমার সামান্য জামাকাপড়। আর আমার মেয়ের জন্য কেনা একটা বড় পুতুল। লকডাউনের আগেই আমি কিনেছিলাম। এতবড় পুতুল মেয়েকে কোনওদিন কিনে দিইনি। পুতুলটা কথা বলতে পারে না। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। ঠিক যেন আমার মেয়েটাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। মেয়ের জন্মদিনের আগে আমি বাড়ি পৌঁছতে চাই। এই প্রথম আমরা মেয়ের জন্য ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ গাইব।
সেদিন দ্বিতীয় লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও হাঁটা শুরু। আমরা জানি, আমাদের সবার বাড়ি অনেক দূরে। বর্ধমান, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা। আমরা দল বেঁধে হেঁটেছি। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। পিচ গলা আগুন পথ। তবু হেঁটেছি। পুলিস বাধা দিয়েছে। হাঁটার জন্য মারও খেয়েছি। ওদের আটকে দিয়েছে। আমি কোনওরকমে ছিটকে আলাদা হয়ে গেছি। পুলিসের ভয়ে কখনও জঙ্গলের পথ ধরেছি। কখনও মালবোঝাই লরির মাথায় চেপে এসেছি। মওকা বুঝে লরিওয়ালারা অনেক টাকা নিয়েছে। পকেটের সব টাকা শেষ হয়ে গেছে। এক জেলা থেকে আর এক জেলা। এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্য। তবু আমি থামিনি। আমার সঙ্গে খাবার নেই, জল নেই। তবু হেঁটেছি। দিনে হেঁটেছি। রাতে হেঁটেছি। রাস্তাতেই গাছতলায় একটু বিশ্রাম নিয়েছি। কেউ কিছু দিলে খেয়েছি। না হলে উপোস।
কতদিন ধরে হেঁটেছি ঠিক মনে নেই। কতবার লরি, টেম্পায় চেপেছি তারও ঠিক নেই। বার তারিখেরও হিসেব নেই। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় শেষ দিকে সারাক্ষণ বন্ধ করে রেখে দিতাম চার্জ বাঁচিয়ে রাখার জন্য। একবার খুলে শ্যামলীর সঙ্গে একটু কথা বলতাম। তবু সব বাধাকে হারিয়ে আমি হেঁটেছি আমার মা, আমার মেয়ে, আমার পরিবারের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু শেষকালে এখানেই থামতে হল। আমার কোনও কথা ওরা শুনল না। এখন চোদ্দো দিনের জন্য সরকারি কোয়ারেন্টাইনে বন্দি আমি।
রাতে আমাদের খাবার দিল। ভাত আর একটা তরকারি। কতদিন পরে দু’টো ভাত খেলাম। খাওয়া দাওয়ার পর সবাই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। এবার অন্ধকার ঘর থেকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, ভরা জ্যোৎস্না। উঠে জানলায় এসে আকাশের দিকে তাকালাম। থালার মতো গোল চাঁদ। তারমানে পূর্ণিমা। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বলল, আজকে মনে হয় বুদ্ধ পূর্ণিমা।
এই পূর্ণিমার ঠিক চারদিন পর আমার মেয়ে হয়েছিল। তাই শ্যামলী মেয়ের নাম রেখেছে পূর্ণিমা। তাহলে হিসেব মতো আর চারদিন পর আমার মেয়ের জন্মদিন। কালকে একবার সরকারি বাবুদের বলতে হবে, যদি দয়া করে আমাকে ছেড়ে দেয়। আমার তো জ্বর, সর্দি, কাশি কোনও সমস্যাই নেই। যদি অন্তত মেয়েটার জন্মদিনের আগে বাড়ি পৌঁছতে পারি। এখান থেকে হেঁটে গেলেও দেড় দু’দিন লাগবে।
অনেকদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরিই হয়ে গেল। আমরা যখন কাজ করি তখন কত সকালে উঠতে হয়। কোনও কাজ নেই। আজ আর হাঁটাও নেই। তাই মনে হয় ঘুম ভাঙেনি। এখন সবাই উঠে পড়েছে। কিন্তু কারও কিছু করার নেই। তাই যে যার মতো বসে আছে। গল্প করছে। এখানে তো মনে হয় একটু চাও মিলবে না। দুপুরে হয়তো খাবার দেবে। সকালের জলখাবার দিতেও পারে। জানি না কিছু।
পাঁচিলের ভেতরে আমরা বড় একটা দোতলা বাড়িতে। ঘরের বাইরে এসে বুঝলাম এটা স্কুল বাড়ি। নাম লেখা রয়েছে ‘প্রীতিময়ী গার্লস হাই স্কুল।’ এটা গার্লস স্কুল। আমার মেয়েকে এরকমই একটা স্কুলে ভর্তি করব। আমাদের গঞ্জেও একটা গার্লস স্কুল আছে। সেই স্কুলে পড়বে মেয়ে। সবুজসাথীর সাইকেল, কন্যাশ্রীর টাকা পাবে। মেয়েকে আমরা বড় করব। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি আমার মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে।
শ্যামলীকে একটা ফোন করে খোঁজ নেব বলে মোবাইলটা বের করে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফোন হল না। মনে হয় ভ্যালিডিটি শেষ হয়ে গেছে। থাক, শ্যামলী তো ফোন করবে। হঠাৎ দেখি দু’জন বয়স্ক মেয়েমানুষ, একটা লোক, আর দু’টো মেয়ে এসে অফিস ঘরের দিকে গেল। সবার মুখে মাস্ক। কী করবে কে জানে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, ‘কালকে বিকেলে দু’জন লোক এসে বলেছিল, সকালে নাকি একটু গানটান করবে। আমাদের সবাইকে একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য। আমরা তো এখানে বন্দি। জিজ্ঞেস করেছিল আমাদের কেউ গানটান জানি কিনা।’
তাহলে ওরা সেই জন্যে এসেছে। আমি আবার ঘরে ফিরে এলাম। শ্যামলীর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হতো। মা কেমন আছে কে জানে। মনটা বড় উতলা হয়ে আছে। এখনও শ্যামলী একটা ফোন করল না।
বেশ খানিকক্ষণ পর বাইরে থেকে কেউ যেন ডাকল, তোমরা সবাই বাইরেটা এসো। দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াও।
আমরা বাইরে বেরোলাম। অন্য ঘর থেকে আরও কয়েকজন এল। দেখি টানা বরান্দায় একটা টেবিলের ওপর মালা দেওয়া একটা ছবি। চিনতে পারলাম, ওটা রবি ঠাকুরের ছবি। বয়স্ক মহিলা মনে হয় দিদিমণি হবেন। বললেন, আজ পঁচিশে বৈশাখ, রবি ঠাকুরের জন্মদিন…
আজকে পঁচিশে বৈশাখ? তাহলে তো আজকেই আমার মেয়েরও জন্মদিন। তারিখটা তো আমার মনে আছে। শুধু হিসেব নেই। লকডাউন আমার সব ওলটপালট করে দিয়েছে। এখন আমি কী করব? হে ঠাকুর, তুমি আমাকে আমার মেয়ের কাছেও একটু পৌঁছে দিলে না? বাড়ির কাছে এনেও এখানে বন্দি করে দিলে? এখনই ফোন করতে হবে শ্যামলীকে। কিন্তু কীভাবে ফোন করব? একজনের কাছে চাইলাম। সে বলল, তার ফোন নেই।
আমি লাইন ছেড়ে ঘরে এসে ব্যাগ থেকে মেয়ের জন্য আনা পুতুলটা বের করলাম। পুতুলের চোখ দু’টো খুব করুণ দেখাচ্ছে। যেন আমার মেয়েটাই কাঁদো কাঁদো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘বাবা তুমি আমার জন্মদিনে আসলে না।’ এখন আমি কী করে যাব রে মা? এখন তোর কাছে যাওয়ার যে কোনও রাস্তা নেই।
হঠাৎ আমার ফোনটা বাজল। শ্যামলীর ফোন। তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরলাম। আমি হ্যালো হ্যালো বললেও ওপাশ থেকে শুধু কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না। আমি জিজ্ঞেস করি, শ্যামলী, কী হয়েছে?
অনেকক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে শ্যামলী বলল, মা এইমাত্র…। আর কিছু বলতে পারল না, আবার হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।
আমার মা আর বেঁচে নেই। এইমাত্র মা মরে গেছে। কালকেই শ্যামলী বলেছিল, মায়ের খুব শ্বাসের টান উঠেছে। আমি আর মাকে দেখতে পেলাম না। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন। আজ আমার মায়ের মৃত্যুদিন। আমরা মা কি বেঁচে থাকবে আমার মেয়ের মধ্যে? আমি জানি না। আমার মতো পরিযায়ীরা তা জানে না।
শ্যামলী কাঁদছে। পাশে দাঁড়িয়ে আমার মেয়ে কাঁদছে, বোন কাঁদছে। আমি টের পাচ্ছি ফোনের ওই প্রান্তে শুধুই কান্নার শব্দ। আমারও বুকভাঙা কান্না বেরিয়ে এল। কিন্তু আমার কান্না কেউ শুনতে পেল না। স্কুলের বারান্দায় তখন পঁচিশে বৈশাখের গান গাইছে কেউ।
শেষ