কঠোর লড়াই করে মন ভেঙে গিয়েছে। স্বপ্ন হয়েছে ফ্যাকাসে। বয়সও বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে টপার হওয়ায় সোনার পদকও রয়েছে বাড়িতে। রাজ্য ও কেন্দ্রস্তরে চাকরির পরীক্ষাতেও বসেছেন। কিন্তু শিকে ছেঁড়ে নি। ‘একদিনে না হলেও, একদিন হবেই’ এই বিশ্বাস নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন ঠাকুরনগরের বাসিন্দা রাজু মণ্ডল। বেকারত্ব মানেই যে ভেঙে পড়া নয়, চাইলেই যে স্বনির্ভর হওয়া যায় তা দেখিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তাই ‘আত্মনির্ভরতা’র জন্য চাঁদপাড়ায় রাজু গড়ে তুলেছেন শিক্ষিত বেকার ক্যাফে।
গাইঘাটার চাঁদপাড়া স্টেশন সংলগ্ন শালবনি লেভেল ক্রসিং। পাশে একটি খাবারের দোকান রয়েছে। যার নাম ‘শিক্ষিত বেকার ক্যাফে’। দোকানের মালিক হলেন রাজু মণ্ডল। অদ্ভুত নামকরণ দেখে হতভম্ব পথচলতি মানুষ। রাজুর বাড়ি ঠাকুরনগরের শিমুলপুর এলাকায়। বাবা মণিমোহন মণ্ডল পেশায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন ভিন রাজ্যে। কোমড়ে চোট নিয়েই কাজ করছেন পুণেতে। ঠাকুরনগরের বাড়িতে থাকেন রাজু, তাঁর মা মায়া মণ্ডল ও ছোট বোন। রাজুর পড়াশোনা শুরু শিমুলপুর আনন্দপাড়া নরহরি বিদ্যাপীঠে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন এই স্কুল থেকেই। উচ্চমাধ্যমিকে গাইঘাটা ব্লকে রাজু সেরা হয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের গণ্ডি টপকে হরিণঘাটা কলেজ থেকে এডুকেশন নিয়ে স্নাতক হন ২০১৮ সালে। পরে এমএ পাশও করেন। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। পরে বিএড করেন। বরাবরই অধ্যাপক হওয়ার ইচ্ছা রাজুর। তাই নেট ও সেট পরীক্ষাতেও রাজু পাস করেন।ইন্টারভিও হয়েছে। কিন্তু, প্যানেল এখনও প্রকাশিত হয় নি। জোটে নি চাকরি। এখন, পিএইচডি-র জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাই নয় রাজুর লেখা একাধিক বই পড়ানো হচ্ছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বই প্রকাশ করার জন্যও প্রকাশন সংস্থার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন তিনি।
একটা সময় বহু কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়েছে রাজুকে। গ্রামীণ এলাকায় যাঁরা টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে সমস্যায় রয়েছেন, তাঁদের জন্য এগিয়ে এসেছেন রাজু। একপ্রকার বিনামূল্যে একাদশ শ্রেণি থেকে কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন তিনি।
রাজু বলেন, আমার স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার। কিন্তু, এখনও চাকরি পাইনি বাবাও অসুস্থ। সংসার চালাতে ক্যাফে চালাচ্ছি। আমি একজন শিক্ষিত বেকার। তাই ক্যাফের এই নামকরণ। ছোট এই দোকানের আমিই মালিক। এটা আমার কাছে অহংকারের। আমার ওপর এটা নিয়ে কেউ কিছু বলবে না। চাকরি না পেয়ে স্বনির্ভর হতে আমি এই ব্যবসা করছি। চাকরি পেতেই হবে এটা জেদ। অন্যদিকে না পেলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ঠিক নয়। আমার মতো যাঁরা শিক্ষিত বেকার রয়েছেন, তাঁদের কাছে এই বার্তা দিতে চাই। এই ক্যাফেতে আমি নিজেই চাউমিন সেদ্ধ, স্যালাড তৈরি, দোকান সাজায়। দুপুরের পর ক্রেতাদের ভিড় বাড়ে। তখন নিজে অর্ডার অনুযায়ী মেনু টেবিলে পরিবেশন করি। পরে খাবারের প্লেট আমি নিজেই তা পরিস্কার করি। আমরা আশা একদিন লক্ষ্যে পৌঁছাবই। তখন আমার অসময়ের সঙ্গী এই দোকানটি থাকবে।
শুক্রবার বিকালে রাজুর শিক্ষিত বেকার ক্যাফেতে খাবার খেতে এসেছিলেন অবন্তিকা রায়। তিনি বলেন, সত্যি লড়াই যেন থামছে না রাজুর। তবে,কোনও কিছুতেই হাল ছাড়তে নেই। এত ডিগ্রি থাকার পরেও চাকরি না পাওয়াই ক্যাফে খুলতে হচ্ছে এটাই অবাক করার। আমরাও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি।