মল্ল রাজারা আর নেই, নেই রাজ্যপাট। ভাঙ্গাচোরা রাজবাড়ির দেওয়ালে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায় মল্লরাজাদের প্রাচীন ইতিহাসের পদধ্বনি। প্রাচীন রীতি ও ঐতিহ্য মেনে শুক্রবার বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের দুর্গোৎসবের সূচনা হয়ে গেল। অন্যান্য বছর নির্দিষ্ট এই দিনে পুজো শুরু হয়ে টানা ১৮ দিন পুজো হতো। এবার ব্যতিক্রম। মহালয়ার ১ মাস পর শারদীয়া দূর্গোৎসব। ফলে বাড়তি একমাস পুজো চলবে। ‘পট পুজো’ই এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শহরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকতা মেনে আজও ফি বছর বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোট ঠাকুরাণীর আলাদা-আলাদা তিনটি পট আঁকেন। মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশেই নির্দিষ্ট জায়গায় এই তিনটি পট রেখে পুজো হয়। এদিন নবম্যাদি কল্প থেকে বড় ঠাকুরাণী অর্থাৎ দেবী মহালক্ষীর পুজো শুরু হল। সকালে রাজবাড়ি সংলগ্ন রঘুনাথ সায়ের এ বড়ঠাকুরাণীর পটের স্নান পর্ব শেষে মন্দিরে প্রবেশের পর প্রথানুযায়ী তিন বার মূর্চ্ছা পাহাড়ে কামানের তোপধ্বনি দেওয়া হল। পরে গর্ভগৃহে প্রবেশের মুহূর্তেও তোপধ্বণি দেওয়া হয়। পরে দেবীকে অন্নভোগ নিবেদনের সময় আরো তিনবার কামানের তোপধ্বণী দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে বড় ঠাকুরাণীর পুজোর দিন থেকেই মল্ল রাজাদের প্রাচীণ এই রাজধানীতে শারদোৎসবের সূচণা হয়ে গেল।
প্রথানুযায়ী, দেবীপক্ষের চতুর্থীর দিন থেকে রাজপরিবারের মেজ ঠাকুরানী অর্থাৎ দেবী সরস্বতী ও সপ্তমীর দিন থেকে ছোটো ঠাকুরাণী অর্থাৎ দেবী মহাকালীর পুজো শুরু হয়। বড়, মেজো ও ছোট ঠাকুরাণী এই তিনজনই দেবী মহামায়ার রুপ হিসেবে মল্লরাজাদের হস্ত লিখিত বলীনারায়নী পুথি অনুযায়ী পূজিতা হন।
৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দ, বাংলা ৪০৪ সাল, মল্লাব্দ ৩০৩ মল্লাব্দে তৎকালীন রাজা জগৎ মল্ল স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর বিষ্ণুপুরে দেবী মৃন্ময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি মল্ল রাজাদের কূলদেবী। অতীতে রাজাদের আমলে যে আড়ম্বর ছিল সময়ের দাবী মেনে তাতে কিছু ভাটা পড়লেও শহরবাসীর মধ্যে উৎসাহে ভাটা এতোটুকুও কমেনি, বরং বেড়েছে। অন্যান্য পুজো কালিকাপূরাণ মতে হলেও এই রাজ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুর রাজ পরিবারে বলিনারায়ণী মতে দুর্গাপূজা হয় বলে দাবী করা হয়। একসময় এখানে পূজোয় বলি প্রথা চালু থাকলেও রাজা হাম্বির মল্ল বৈষ্ণব মতে দীক্ষা নেওয়ার পর চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় বলি প্রথা।
তোপধ্বণীর শব্দকে ব্রহ্ম হিসেবে ধরে সেই সময় থেকেই পাহাড়ের উপর কামানের তোপধ্বণীর চালু বলে জানা গেছে। প্রাচীণ রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর অষ্টমীর দিন থেকেই মন্দিরের গর্ভগৃহে অষ্ট ধাতু নির্মীত বিশালাক্ষ্মী ও নবমীর রাতে খচ্চরবাহিনী দেবীর পুজো হয়। বিজয়া দশমীতে দেবী মৃন্ময়ীর ঘট বিসর্জনের পর বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোট ঠাকুরাণীর ঘট বিসর্জন হয়। সব শেষে এই তিন ঠাকুরাণীর পট রাজবাড়ির অন্দর মহলে নিয়ে যাওয়া হয়।
মল্লরাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য জ্যোতি প্রসাদ সিংহ ঠাকুর মহারাজ জগদমল্লের হাত ধরে ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে পুজো শুরুর বলেন, পঞ্জিকা মতে সপ্তমী তিথির পুজো শুরুর ১৪ দিন আগে এখানে পুজো শুরু হয়। যদিও এবছর ব্যতিক্রম। আশ্বিন মাসে দু’টি অমাবস্যায় পড়ে যাওয়ায় ‘মল মাস’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় এক মাস পরে আনুষ্ঠানিক পুজো শুরু হবে। কিন্তু মা মৃন্ময়ীর পুজো শুরুর কোন ব্যতিক্রম হয়নি। পুজো শুরু হলো এবং তা চলবে। বড় ঠাকুরাণী এলেন। পর্যায়ক্রমে নিয়ম মেনে মেজো ঠাকুরাণী ও ছোটো ঠাকুরাণী আসবেন। অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে রাজ অঞ্জলী হবে, তোপধ্বনীও হবে। এ অষ্টমী- নবমীর মধ্যরাত্রীতে খচ্চর বাহিনীর পুজোর প্রথা চালু রয়েছে। বিজয়মা দশমীতে বিশালাক্ষী দেবীর রাজগৃহে প্রবেশ ও নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর পর দইয়ের মধ্যে চ্যাং মাছ ছেড়ে পুজোর সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।
রাজ পুরোহিত সুপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখানে মালক্ষী, মা সরস্বতী ও মা কালী এই তিন রুপে পুজিতা হন। এক পক্ষকালের জন্য মা জগজ্জনী, এবছর আশ্বিন মাস মল মাস পড়ে যাওয়ায় এভাবেই চলবেন। কার্তিকে শারদোৎসব শুরু হবে বলে তিনি জানান। সারা বছরের পাশাপাশি পুজোর এই দিন গুলিতে মন্দির নগরীতে বিষ্ণুপুরে পর্যটকদের ঢল নামে। প্রাচীন ঐতিহ্য আর পরম্পরার সাক্ষী থাকতে আজও জেলা, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ ভীড় করেন। সব মিলিয়ে মল্লরাজারা না থাকলেও তাঁদের কীর্তির জেরে বিষ্ণুপুর আছে বিষ্ণুপুরেই।
বাঁকুড়া থেকে মৃন্ময় পানের রিপোর্ট*আজ বাংলামল্ল রাজারা আর নেই, নেই রাজ্যপাট। ভাঙ্গাচোরা রাজবাড়ির দেওয়ালে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায় মল্লরাজাদের প্রাচীন ইতিহাসের পদধ্বনি। প্রাচীন রীতি ও ঐতিহ্য মেনে শুক্রবার বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের দুর্গোৎসবের সূচনা হয়ে গেল। অন্যান্য বছর নির্দিষ্ট এই দিনে পুজো শুরু হয়ে টানা ১৮ দিন পুজো হতো। এবার ব্যতিক্রম। মহালয়ার ১ মাস পর শারদীয়া দূর্গোৎসব। ফলে বাড়তি একমাস পুজো চলবে। ‘পট পুজো’ই এখানকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শহরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকতা মেনে আজও ফি বছর বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোট ঠাকুরাণীর আলাদা-আলাদা তিনটি পট আঁকেন। মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশেই নির্দিষ্ট জায়গায় এই তিনটি পট রেখে পুজো হয়। এদিন নবম্যাদি কল্প থেকে বড় ঠাকুরাণী অর্থাৎ দেবী মহালক্ষীর পুজো শুরু হল। সকালে রাজবাড়ি সংলগ্ন রঘুনাথ সায়ের এ বড়ঠাকুরাণীর পটের স্নান পর্ব শেষে মন্দিরে প্রবেশের পর প্রথানুযায়ী তিন বার মূর্চ্ছা পাহাড়ে কামানের তোপধ্বনি দেওয়া হল। পরে গর্ভগৃহে প্রবেশের মুহূর্তেও তোপধ্বণি দেওয়া হয়। পরে দেবীকে অন্নভোগ নিবেদনের সময় আরো তিনবার কামানের তোপধ্বণী দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে বড় ঠাকুরাণীর পুজোর দিন থেকেই মল্ল রাজাদের প্রাচীণ এই রাজধানীতে শারদোৎসবের সূচণা হয়ে গেল।
প্রথানুযায়ী, দেবীপক্ষের চতুর্থীর দিন থেকে রাজপরিবারের মেজ ঠাকুরানী অর্থাৎ দেবী সরস্বতী ও সপ্তমীর দিন থেকে ছোটো ঠাকুরাণী অর্থাৎ দেবী মহাকালীর পুজো শুরু হয়। বড়, মেজো ও ছোট ঠাকুরাণী এই তিনজনই দেবী মহামায়ার রুপ হিসেবে মল্লরাজাদের হস্ত লিখিত বলীনারায়নী পুথি অনুযায়ী পূজিতা হন।
৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দ, বাংলা ৪০৪ সাল, মল্লাব্দ ৩০৩ মল্লাব্দে তৎকালীন রাজা জগৎ মল্ল স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর বিষ্ণুপুরে দেবী মৃন্ময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি মল্ল রাজাদের কূলদেবী। অতীতে রাজাদের আমলে যে আড়ম্বর ছিল সময়ের দাবী মেনে তাতে কিছু ভাটা পড়লেও শহরবাসীর মধ্যে উৎসাহে ভাটা এতোটুকুও কমেনি, বরং বেড়েছে। অন্যান্য পুজো কালিকাপূরাণ মতে হলেও এই রাজ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুর রাজ পরিবারে বলিনারায়ণী মতে দুর্গাপূজা হয় বলে দাবী করা হয়। একসময় এখানে পূজোয় বলি প্রথা চালু থাকলেও রাজা হাম্বির মল্ল বৈষ্ণব মতে দীক্ষা নেওয়ার পর চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় বলি প্রথা।
তোপধ্বণীর শব্দকে ব্রহ্ম হিসেবে ধরে সেই সময় থেকেই পাহাড়ের উপর কামানের তোপধ্বণীর চালু বলে জানা গেছে। প্রাচীণ রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর অষ্টমীর দিন থেকেই মন্দিরের গর্ভগৃহে অষ্ট ধাতু নির্মীত বিশালাক্ষ্মী ও নবমীর রাতে খচ্চরবাহিনী দেবীর পুজো হয়। বিজয়া দশমীতে দেবী মৃন্ময়ীর ঘট বিসর্জনের পর বড় ঠাকুরাণী, মেজ ঠাকুরাণী ও ছোট ঠাকুরাণীর ঘট বিসর্জন হয়। সব শেষে এই তিন ঠাকুরাণীর পট রাজবাড়ির অন্দর মহলে নিয়ে যাওয়া হয়।
মল্লরাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য জ্যোতি প্রসাদ সিংহ ঠাকুর মহারাজ জগদমল্লের হাত ধরে ৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে পুজো শুরুর বলেন, পঞ্জিকা মতে সপ্তমী তিথির পুজো শুরুর ১৪ দিন আগে এখানে পুজো শুরু হয়। যদিও এবছর ব্যতিক্রম। আশ্বিন মাসে দু’টি অমাবস্যায় পড়ে যাওয়ায় ‘মল মাস’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় এক মাস পরে আনুষ্ঠানিক পুজো শুরু হবে। কিন্তু মা মৃন্ময়ীর পুজো শুরুর কোন ব্যতিক্রম হয়নি। পুজো শুরু হলো এবং তা চলবে। বড় ঠাকুরাণী এলেন। পর্যায়ক্রমে নিয়ম মেনে মেজো ঠাকুরাণী ও ছোটো ঠাকুরাণী আসবেন। অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে রাজ অঞ্জলী হবে, তোপধ্বনীও হবে। এ অষ্টমী- নবমীর মধ্যরাত্রীতে খচ্চর বাহিনীর পুজোর প্রথা চালু রয়েছে। বিজয়মা দশমীতে বিশালাক্ষী দেবীর রাজগৃহে প্রবেশ ও নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর পর দইয়ের মধ্যে চ্যাং মাছ ছেড়ে পুজোর সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।
রাজ পুরোহিত সুপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখানে মালক্ষী, মা সরস্বতী ও মা কালী এই তিন রুপে পুজিতা হন। এক পক্ষকালের জন্য মা জগজ্জনী, এবছর আশ্বিন মাস মল মাস পড়ে যাওয়ায় এভাবেই চলবেন। কার্তিকে শারদোৎসব শুরু হবে বলে তিনি জানান। সারা বছরের পাশাপাশি পুজোর এই দিন গুলিতে মন্দির নগরীতে বিষ্ণুপুরে পর্যটকদের ঢল নামে। প্রাচীন ঐতিহ্য আর পরম্পরার সাক্ষী থাকতে আজও জেলা, রাজ্য, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ ভীড় করেন। সব মিলিয়ে মল্লরাজারা না থাকলেও তাঁদের কীর্তির জেরে বিষ্ণুপুর আছে বিষ্ণুপুরেই।