সারা দেশ যখন পুণ্য অর্জনের লক্ষে মকর সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন নদী, সাগরে স্নান করতে চাইছেন।সেই সময়ে ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর,হুগলির মত জেলাগুলিতে রীতিমতো আনন্দ করে পালিত হচ্ছে টুসু পরব।
এই পার্বণগুলিও ভিন্নতর স্বাদের এবং অদ্ভুত সুন্দরও।এই টুসু পরব পালিত হয় পৌষ সংক্রান্তির দিন। এই পরবের মাধ্যমে কুড়মি লোকজীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের জীবনকাহিনী সবথেকে বেশী ধরা পড়ে যে গানে তা হল টুসু গান।
টুসু নাম করনের পেছনে বহু মতামত আছে।ওনেকেই বলেথাকেন , “এই শস্যোৎসবে ধানের খোসা তুষ একটা বড় উপকরণ। তাই ‘তুষ’–এর সঙ্গে আদরার্থক উ-প্রত্যয়যোগে ‘তুষু’ নামটি এসেছে।অনেকে আরো বলেন, ‘টুসু’ নামকরণের পিছনে কোল গোষ্ঠীর ‘টুসা’ (টুসাউ) শব্দটির প্রভাব থাকতে পারে। কোল ভাষায় এর অর্থ হল—ফুলের গুচ্ছ।
টুসু উৎসব অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয়।
ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ি দিয়ে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি, বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল,গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রাখা হয়।এরপর পাত্রটিকে প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পুজা করা হয়েথাকে।
পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর কাছে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রচলিত অভিজ্ঞতা সুর করে গানের মাধ্যমে বলে ও দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ভোগ দেয়।
টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিন – বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নাতাদিয়ে পরিষ্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করে। বাঁউড়ির দিন – অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টির পুড় দিয়ে ভর্তি করে। বাঁউড়ির দিন রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ হয়ে থাকে।এই সময় মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেথাকে।
পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সজ্জিত চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে গাইতে দেবীর বিসর্জন করে থাকে। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। ছেলেরা খড়, কাঠ, পাটকাঠি দিয়ে ম্যাড়াঘর বানিয়ে তাতে আগুন জ্বালায়।
টুসু ঘরের মেয়ে। ফসল রূপী আবাদের দেবী।
তাই এই ঘরের শস্যরূপী দেবীর কাছেই যত আবদার, অভিযোগ এবং তার কাছেই আনন্দের প্রকাশ। গানগুলিতে তারই প্রকাশ ঘটে। টুসু গান প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।এই গান গুলোকে শুনে শুনে মনে রাখতে হয়। আর সেই ভাবেই হাজার বছরেরও বেশি বয়স হয়ে গিয়েছে টুসু গানগুলির।
“উপরে পাটা নীচে পাটা
তার ভিতরে দারোগা
ও দারোগা পথ ছাড়ে দাও
টুসু যাবেন কলকেতা টুসু যাবেন
কলকেতা খিদে পেলে খাবেন কি?
আনগো টুসুর নতুন গামছা
জিলিপি ছাঁদা বাঁধে দি।”
কালে কালে টুসু উৎসবের পুরনো গৌরব হারিয়ে যেতে বসেছে। তবু আজও মকর সংক্রান্তিতে গ্রামের মেঠো পথে সর্ষে ক্ষেতের ওপার থেকে টুসু গানের সুর শোনা যায়। মনে হয়, না, রাঢ়বঙ্গ এখনও তার বৈশিষ্ট্যকে হারিয়ে যেতে দেয়নি।