আরামবাগ মহকুমার মানুষকে যখন লকডাউন মানাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে, তখন তথাকথিত আরামবাগের লকডাউন না মানা মানুষের গালে সজোরে থাপ্পড় মারলেন এক লরি চালক। তিনি লরি নিয়ে পেশার তাগিদে বিভিন্ন জেলায় ছুটে বেড়ান। ২৪ মার্চ তারিখ প্রধানমন্ত্রী সারাদেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করার পর, তার লরি চালানো বন্ধ। যখন বিভিন্ন এলাকায় রাজ্যের বাইরে থাকা বা ভিন্ন জেলায় থাকা হাজার হাজার মানুষ বাড়ি ফিরে এসেছে এবং তাদের অনেকেই লকডাউনের তোয়াক্কা না করে অবলীলায় এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে তখন নিজেকে ১৪ দিন ধরে লরির মধ্যে বন্দী করে ফেলেছেন। তার লরি হয়ে উঠেছে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। ঘটনাটি আরামবাগ গোঘাট থানার রঘুবাটি পঞ্চায়েতের এলাকার। ওই ব্যক্তির নাম তুষার মালিক(৫০)।
দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে লরি চালাচ্ছেন তিনি। বেশ কিছুদিন ধরে বালি তুলে বর্ধমান ও পাশাপাশি জেলাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। লকডাউন ঘোষণার পর থেকে তিনি ওই গ্রামের বটতলা এলাকায় লরির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তুষার নিজে বিয়ে করেননি। কিন্তু বাড়িতে আছে বৃদ্ধ মা, দাদা,, বৌদি,ভাইপো, ভাইঝি সহ পুরো পরিবার। তাই বাড়িতে না ঢুকে গ্রামের বাইরে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। তিনি বলছেন যারা বাইরে থেকে আসছে তাদের প্রশাসন বলছে নিজেদের গৃহবন্দি রাখতে। কিন্তু যদি সে কোন কারনে করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে বাড়িতে গেলে বাড়ির লোকের ছোঁয়াচ লাগতে পারে। তাই বাড়ি না গিয়ে গ্রামের বাইরে লরিতে দিন কাটাচ্ছেন। বাড়ির লোকেরা নিয়ম করে তাকে খাবার পৌঁছে দিয়ে যায়। সে চায় না তার জন্য তার পরিবার বা গ্রামের মানুষ কোনরকম বিপদে পড়ুক। তুষার বাবুর ঘটনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। প্রতিবেশী সাহেব মালিক বলছেন তুষার এমনিতে হাসিখুশি মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে লরি চালাচ্ছে।গ্রামে এলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। যেহেতু সে বিবাহিত নয় তাই কখনও কখনও এর ওর বাড়িতেও খেয়েও নেয়। কিন্তু আজ প্রায় ১৩-১৪ গ্রামের মানুষের কথা ভেবে গ্রামের বাইরে দিন কাটাচ্ছেন। গ্রামের মানুষ ও সময় পেলে লরি থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে তার সাথে গল্প করে আসে। যাতে তার একেবারে একা না লাগে। অনেকেই তাকে বাড়িতে ফিরে একটি নির্দিষ্ট ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামের মানুষের কথা ভেবে সে রাজি হয়নি।
প্রতিদিন সকাল হলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ মানুষকে ঘরবন্দি করতে সচেতনতা প্রচার করছেন। কখনো লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে মানুষকে ঘর ঢোকাচ্ছেন। অনেককেই অকারণে ঘোরাঘুরি জন্য পুলিশকে আটক করতে হয়েছে। প্রতিদিন সকালে বিভিন্ন বাজারগুলোতে গেলে দেখা যাচ্ছে ন্যূনতম সামাজিক দূরত্বের তোয়াক্কা না করে ভিড় জমাচ্ছেন সাধারণমানুষ। সেখানে অধ্যাপক থেকে চিকিৎসক, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষই ভিড় করছেন। হাজার চেষ্টা করেও তাদেরকে দিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যায়নি। অথচ এক সাধারণ লরি চালক নিজের পরিবারকে এবং নিজের গ্রামকে রক্ষা করতে যে কাণ্ড ঘটিয়েছেন তা রীতিমতো তারিফ করার মতো। গোঘাট এক নম্বর ব্লকের বিডিও অবশ্য বলছেন তিনি এই ঘটনার কথা জানেন না। আমাদের প্রতিনিধির কাছ থেকেই প্রথম শুনলেন। দ্রুত ওই লরি চালককে নির্দিষ্ট সেন্টারে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।
তবে প্রতিবেশীরা বলছেন প্রায় ১৪ দিন কাটিয়ে ফেলেছেন তুষার। এবার বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। বিডিও কিছু না জানলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অবশ্য বিষয়টি জানেন। তারা বলছেন তুষারকে বলা হয়েছিল।বাড়ি অথবা সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকার জন্য। সে রাজি হয়নি। সে বলছে লরির মধ্যে সে নিজেকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখছে। সে কোনভাবেই চায় না তার জন্য কোয়েন্টিন সেন্টারের চিকিৎসকরা বিব্রত হোক। এলাকার বিশিষ্টজনেরা বলছেন একজন সাধারণ লোক আজ আরামবাগ মহকুমার মানুষকে দেখিয়ে দিল বিপদের দিনে কিভাবে চলাফেরা করতে হয়। তুষারের কাছ থেকে যারা লকডাউন না মেনে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাদের শেখা উচিত। সোজা কথা অন্ধ সমাজের আজ চোখ খুলে দিল তুষার। একজন লরির সাধারণ চালক যা করতে পারেন আমাদের সমাজের অনেক কেষ্ট বিষ্টু তা করতে পারেনা। তুষারের ঘটনার কথা প্রকাশ পাওয়ার পর যদি এই শিক্ষিত সমাজের একটুও লজ্জা বোধ হয় তাহলে হয়তো আমাদের এলাকা করোনামুক্ত থাকবে।