গোপাল মিস্ত্রি
ভালোদাদু বলল, আজকে তোদের একটা দেউল দেখাতে নিয়ে যাব, হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। যাবি?
আমি তো লাফিয়ে উঠলাম, মিষ্টিদিও হইহই করে উঠল, হ্যাঁ ভালোদাদু, আমরা যাব।
ভালোদাদু বলল, ঠিক আছে তাহলে দুপুরের পর আমরা রওনা দেব।
আমরা মানে আমি, মিষ্টিদি আর ভুতুম। মিষ্টিদি আমার পিসতুতো দিদি। ভালোদাদুর ডাকাত ধরার গল্প শুনে চুচুঁড়া থেকে চলে এসেছে। আমার চেয়ে এক ক্লাস ওপরে পড়ে। কিন্তু আমাদের বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে বায়না ধরল বৃষ্টি। ও সবার ছোট বলে আমরা না না করছিলাম। কিন্তু ভালোদাদুই বলল, ঠিক আছে বৃষ্টিও যাবে।
শীতের দুপুর। খাওয়াদাওয়ার পরই একটা টোটো করে আমরা রওনা দিলাম। ভালোদাদুই গ্রামের টোটো বলে রেখেছিল। গোঁওওও শব্দ করে টোটোটা চলছে। চলতে চলতেই ভালোদাদু বলল, জানোতো মিষ্টি দিদিভাই, সেই ডাকাত দু’টো এখন জেলের ভাত খাচ্ছে।
মিষ্টিদি বলল, ইস, আমি থাকলে তো আমিও যেতাম তোমার ভুত-ডাকাত ধরতে। খুব মজা হতো।
ভালোদাদু বলল, মজা তো হতোই। আবার ভয়ও পেতে।
আমি বললাম, বুঝলি মিষ্টিদি, দারুণ ভয় করছিল। ভুতুম তো কেঁদেই ফেলেছিল। তবে ভালোদাদু প্ল্যানটা না করলেও এখনও কিন্তু বাঁশবাগানে ভুতের ভয় থাকত।
টোটোচালক বলল, হ্যাঁ কাকু, আমরা তো সত্যি ভুত ভেবে সন্ধের পর আর এই রাস্তায় যেতামই না। এখন আর কোনও ভয় নেই।
কথা বলতে বলতেই আমরা বাঁশবাগানে চলে এলাম। মিষ্টিদি বলল, দিনের বেলায় তো তেমন কিছুই মনে হয় না। কতবার গেছি এই পথে, বল বুদ্ধু।
আমি বললাম, ঠিকই তো।
ভালোদাদু বলল, সেটাই ভেবে দেখ দিদিভাই। দিনের বেলায় কিছু নেই অথচ রাত হলেই লোকে ভুত দেখত। যাকগে ভুতের কথা ছেড়ে দাও। আজকে আমরা কিন্তু একটা খুব পুরনো দেউল দেখব। আমাদের জেলাতো বটেই রাজ্যেও হয়তো এত পুরনো দেউল হাতে গোনা দু’একটা আছে। হাজার বছরেরও বেশি পুরনো।
ভুতুম জিজ্ঞেস করল, দেউল মানে কী গো ভালোদাদু?
ভালোদাদু বলল, দেউল মানে মন্দির।
মিষ্টিদি জিজ্ঞেস করল, কীসের মন্দির গো ভালোদাদু? কোন ঠাকুর আছে সেখানে?
ভালোদাদু বলল, না গো দিদিভাই, সেখানে কোনও ঠাকুর দেবতা নেই।
মিষ্টিদি আবার জিজ্ঞেস করল, ঠাকুর দেবতা নেই সে আবার কেমন মন্দির?
ভালোদাদু বলল, ওই মন্দিরে কেউ কোনওদিন কোনও ঠাকুরের মূর্তি দেখেনি। ইতিহাস বলছে এটা জৈন মন্দির। জৈন মানে তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমানের নাম জানোতো তোমরা, ইতিহাসে পড়েছ। বৌদ্ধ, জৈন ধর্ম পড়নি?
আমি, মিষ্টিদি সমস্বরে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ পড়েছি তো।
ভালোদাদু বলল, এটা সেই জৈনদের মন্দির। এখানকার একটা প্রস্তরখণ্ডে ১৪৮ তীর্থঙ্করের মূর্তি খোদাই করা ছিল। তা থেকেই প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন এটা জৈন মন্দির। দশম শতকে এই মন্দির তৈরি হয়েছে, মানে প্রায় এগারোশো বছরের পুরনো। একবার ভেবে দেখ। আর একটা মজার জিনিস কী জানো, এখানে কোনও ঠাকুর দেবতা নেই, কিন্তু একটা প্রণামী বাক্স আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুর দেবতা নেই তবে প্রণামী দেয় কারা?
ভালোদাদু বলল, কেউ হয়তো দিত। এখনও হয়তো দেয়।
আমরা এবার ফাঁকা মাঠের ভিতর দিয়ে পাকা রাস্তা ধরে যাচ্ছি। আমরা মামাবাড়ি যাওয়ার সময় যেখান থেকে বাঁক নিয়ে বাঁশবাগানের দিকে যাই, এই রাস্তাটা সেখান থেকেই সোজা চলে গেছে। এই রাস্তায় আগে কোনওদিন যাইনি। এই প্রথম যাচ্ছি বলে সবাই দেখতে দেখতে যাচ্ছি। রাস্তার দু’পাশে কী সুন্দর সবুজ খেত। ভালোদাদু বলল, এই দেখ আলু গাছ। এই মাঠজুড়ে শীতকালে শুধু আলু চাষ হয়।
হঠাৎ ভুতুম হাত দিয়ে দূরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ওটা কী গো ভালোদাদু?
আমরা সবাই সেদিকে তাকালাম। মাঠের শেষে দূরে জঙ্গলের ওপর দিয়ে দেখি পোড়ামাটি রঙের একটা উঁচু মন্দিরের চূড়া। ভালোদাদু বলল, ওটাই তো মন্দিরটা। অনেকদূর থেকে দেখা যায় কেন জানিস, ওটা ২৩মিটার মানে প্রায় আটতলা বাড়ির সমান উঁচু। কাছে গিয়ে দেখবে কী অপূর্ব কারুকাজ করা। ওই মন্দির নিয়ে একটা গল্প আছে। ওখানে তো একটা মন্দির দেখছিস, কিন্তু ওটার নাম সাতদেউল। সাতদেউল মানে সাতটা মন্দির হওয়া উচিত। কিন্তু আমিও ছাটবেলা থেকে একটাই মন্দির দেখছি। কেউ কখনও আর একটাও মন্দির দেখেনি। অথচ নামটা ওইরকম। তবে আমি ছোটবেলায় একটা গল্প শুনেছি। ওখানে নাকি খুব গরিব একজন দুখিনী মা তার সাত সন্তানকে নিয়ে বাস করত। খুব কষ্ট করে সেই মা ছেলেদের মানুষ করে। একদিন তারা অনেক বড় হয়। সাতভাই মায়ের নামে উঁচু মন্দির তৈরি করে। বড় ভাইয়ের মন্দির ছিল সবচেয়ে উঁচু, তারপর ক্রমান্বয়ে ছোট হয়েছে। মন্দির তৈরি শেষ হওয়ার পর বড় ছেলে যখন বলল, মা তোমার ঋণ শোধ। সঙ্গে সঙ্গে সেই মন্দিরটা ভেঙে পড়ল। কিন্তু কেন মন্দিরটা ভেঙে পড়ল তা কেউ বুঝতে পারল না। এইভাবে ছয় ভাইই একে একে যেই বলেছে ‘মা তোমার ঋণ শোধ’ অমনি সব মন্দির ভেঙে পড়েছে। সবার শেষে ছোটভাই ‘মা তোমার ঋণ’ বলেই থেমে গেল। ততক্ষণে মন্দিরের চৃড়া সামান্য হেলে গেছে। কিন্তু ছোট ভাই আর দাদাদের কথা না বলে বলল, ‘মা তোমার ঋণ কখনও শোধ করা যায় না।’ সেই মন্দির আর ভাঙল না। সেই মন্দির আজও এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু নাম রয়ে গেছে সাতদেউল।
ভালোদাদুর গল্প শেষ হতে হতে আমরা এসে গেলাম মন্দিরের সামনে। কী মনোরম জায়গা। গ্রামের বাইরে একটা উঁচু বিরাট বড় চাতাল। সুন্দর ফুলের বাগান। চারদিক তারজালি দিয়ে ঘেরা। লোহার ঘোরানো গেট। ঢুকতে ঢুকতে ভালোদাদু বলল, একসময় এই জায়গাটা পরিত্যক্ত ছিল। চারধারে জঙ্গল, ভাঙা ইটের স্তূপ। আমি ছোটবেলায় এই মাঠে ফুটবল খেলে গেছি। ফুটবল কম্পিটিশন হতো। অনেক পরে আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এটা অধিগ্রহণ করে কী সুন্দর সাজিয়েছে দেখ।
সত্যি খুব সুন্দর জায়গাটা। মিষ্টিদি জিজ্ঞেস করল, এখানে মনে হয় অনেক মানুষ বেড়াতে আসে তাই না ভালোদাদু?
ভালোদাদু বলল, আসে কেউ কেউ। তবে একটা সমস্যা তো আছেই। হাইরোডের ধারে বলে গাড়ি নিয়ে আসা যায়। কিন্তু সবার তো গাড়ি নেই। ট্রেনে আসতে হবে। স্টেশন থেকে টোটো ট্রেকার আছে। তবে এখানে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। কোনও দোকানপাটও নেই। কাউকে আসতে হলে নিজেকে সব ব্যবস্থা করেই আসতে হয়। তাই হয়তো দূরের লোক আসে না। অথচ একটা ঐতিহাসিক দেউল। কোনও প্রচারই নেই। সরকার ইচ্ছে করলে ট্যুরিস্ট স্পট করতে পারে।
সত্যিই, আমরা একজনকেও দেখতে পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেউলের সামনে এলাম। ভালোদাদু বলল, ভালো করে দ্যাখ কী সুন্দর কারুকাজ। এই যে মন্দিরের গঠন দেখছিস একে বলে নাগর রীতির শিখর মন্দির। এই রকম মন্দির দেখা যায় উড়িশ্যায়। সেখানকার রেখ দেউলের আকারে সাজানো এই মন্দিরটি। বাইরের গায়ে দ্যাখ কেমন ধাপে ধাপে আর্চগুলো বড় হয়েছে। একে বলে করবেলড আর্চ।
সামনের লোহার ফাঁকা দরজা দিয়ে মন্দিরের ভেতরটা দেখা যায়। সত্যিই কোনও মূর্তি নেই। ভেতরটা প্রায় পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভালোদাদু যে বলেছিল এখানে একটা প্রণামী বাক্স আছে। সেটা তো দেখা যাচ্ছে না। সেটা কোথায়? আমি কথাটা বলতেই ভালোদাদু দেখে বলল, তাই তো, দরজার ভিতরে একটা প্রণামী বাক্স ছিল তো। তাহলে এখন হয়তো আর নেই।
আমরা সবাই ভেতরটা দেখছিলাম। হঠাৎ মিষ্টিদি বলল, ভালোদাদু দেখো, তালাটা ভাঙা।
সর্বনাশ! তালাটা ভেঙে কেউ বাক্সটা নিয়ে গেছে মনে হয়। আর কেউ তা দেখেনি। ভালোদাদু ভালো করে তালাটা পরীক্ষা করে দেখে বলল, এটাতো মনে হচ্ছে আজকেই ভাঙা হয়েছে। তার মানে দুপুরবেলায় ফাঁকা পেয়ে চোর তালা ভেঙে প্রণামী বাক্সটা নিয়ে গেছে। চল তো চারপাশটা ঘুরে দেখি। সে ব্যাটা নিশ্চয়ই বাক্সটা নেবে না। ভেঙে টাকা পয়সা বের করে বাক্সটা ফেলে দিয়ে যাবে।
আমরা সবাই মিলে একবার মন্দিরের চারপাশটা ভালো করে ঘুরে দেখলাম। সুন্দর বাগানের ফুলগাছের ঝোপটোপের মধ্যে যদি ফেলে দেয়। না, কিছু নেই। ভালোদাদু বলল, তোরা একটু বাগানের সামনের দিকটা দেখ তো। আমি দেখি মালি আছে কিনা।
বড় চত্বরজুড়ে সাজানো বাগান। কত রঙিন ফুল ফুটে আছে। দেখেই বোঝা যায় কেউ রোজ জল দেয়, পরিচর্যা করে। মিষ্টিদি, আমি, ভুতুম আর বৃষ্টি একসঙ্গে সামনের দিকটা দেখছি। পিছন দিকে গেল ভালোদাদু। ওইদিকে কোণের দিকে একটা ঘরও আছে। বোধহয় ওখানেই মালি থাকে।
আমরা যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিকে মানে সামনের দিকে তো একটা মাটির রাস্তা সোজা মাঠের দিকে চলে গেছে। রাস্তার ওপাশেও জঙ্গল। বাঁদিকে বড় একটা বাঁশবাগান। তার ওপাশে সেই পাকা রাস্তাটা। ডানদিকে চাষের জমি, বড় গাছ আর ঝোপজঙ্গল। কিন্তু পিছনদিকে ঘন জঙ্গল। আমরা সীমানা বেড়ার ধার ঘেঁসে চারজনে খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছি। কোথাও কিছু দেখছি না। ডানপাশে বাগানের গাছের ঝোপের আড়ালে, লোহার বেড়ার বাইরের দিকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পুরো বাগান ঘুরে আমরা আবার মন্দিরের সামনে চলে এলাম। কিন্তু ভালোদাদু এখনও আসেনি। ভুতুম বলল, দাদা, ভালোদাদু কোথায় গেল বলতো?
তাই তো, ভালোদাদু তো এখনও এল না। আমরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মিষ্টিদি বলল, চল একবার পিছনটা দেখে আসি।
আমরা পিছন দিকে এলাম। এদিকেও বাগানের গাছে গাছে সুন্দর ফুল ফুটেছে। কিন্তু ভালোদাদু নেই। সেকি? কোথায় গেল? সামনের দিক দিয়ে তো যায়নি। তাহলে? কোণে মালির ঘরের দরজাটা অল্প ফাঁক করা। আমরা ঘরটার কাছে এলাম। মিষ্টিদি দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখে বলল, ভেতরে একটা লোক শুয়ে আছে। দাঁড়া লোকটাকে জিজ্ঞেস করি। বলেই দরজাটা ঠেলে খুলে দিল। দরজার ভিতরে মেঝেতে লোকটা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হাত আর পা দু’টো দড়ি দিয়ে বাঁধা তবে বাঁধনটা আলগা। সর্বনাশ। কে বাঁধল এভাবে। ভালোদাদু নিশ্চয়ই বেঁধে দেয়নি। আমরা ডাকলাম, শুনছেন? কিন্তু লোকটা কোনও সাড়া দিল না। বেশ কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেলাম না তখন মিষ্টিদি বলল, মনে হয় অজ্ঞান হয়ে আছে। আবার মরেও যেতে পারে।
আমি বললাম, খুন হয়ে যায়নি তো?
মিষ্টিদি বলল, না মনে হয়, তাহলে কোনও চিহ্ন থাকত। রক্ত কিংবা পাথরটাথর। আর এরকম চিৎ হয়ে শুয়ে থাকত না।
আমি বললাম, এখন আমরা কী করব? ভালোদাদু কোথায়?
আমরা প্রচণ্ড চিন্তায় পড়ে গেলাম। মিষ্টিদি দরজাটা আবার টেনে দিয়ে বলল, সেটাই তো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। চল আবার খুঁজে দেখি।
আমরা পিছন দিকেই বেড়ার ধার ধরে হাঁটছি। হঠাৎ আমার নজরে পড়ল তারজালির বেড়াটা বেশ খানিকটা ফাঁক করা। আমার সবাই এগিয়ে গেলাম। একটা মানুষ এই ফাঁক দিয়ে ভালোভাবে গলে চলে যেতে পারে। কিন্তু বাইরেটা বেশ নিচু আর ঘন জঙ্গল। ভালোদাদু কি তাহলে এদিক দিয়ে নেমে কোথাও গেল?
বেলা পড়ে এসেছে। আজকে কেন জানি না অন্য কেউ এখানে বেড়াতে আসেনি। তার মানে রোজ লোকেরা আসে না। এবার আমাদের ভয় করছে। আমি একবার ভালোদাদু বলে ডাকলাম। কোনও সাড়া পেলাম না। মিষ্টিদি, ভুতুম, বৃষ্টি সবাই পালা করে ডাকল, কিন্তু কোথাও থেকে কোনও সাড়া পেলাম না।
আমরা আবার দেউলের সামনে চলে এলাম। মিষ্টিদি বলল, চলতো একবার টোটো ড্রাইভার মামাকে জিজ্ঞেস করি ভালোদাদু এদিক দিয়ে গেছে কিনা।
আমরা সবাই গেটের কাছে এসে দেখি টোটোটাও নেই। সেকি! কোথায় গেল টোটোটা? ভালোদাদু আমাদের ফেলে টোটো নিয়ে কোথাও যাবে না। তাহলে? এবার আমাদের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। আমরা একছুটে আবার দেউলের সামনে এসে থামলাম। এত সুন্দর একটা দেউল, যার কত ইতিহাস, সে সব দেখা মাথায় উঠল। ভালো করে কিছুই দেখতে পারিনি। একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। ভালোদাদু নেই, টোটো নেই। এবার এখান থেকে আমরা ফিরব কী করে? ভুতুম আর বৃষ্টি ভয়ে কেঁদেই ফেলল। মিষ্টিদি বলল, বৃষ্টি, ভুতুম কাঁদিস না।
আমি বললাম, এতক্ষণ আমাদের একলা ফেলে ভালোদাদু তো এমনি এমনি যাবে না, তাই না। লোকটা মড়ার মতো পড়ে আছে, ভালোদাদু নেই। ভালোদাদু কোনও বিপদে পড়ল নাকি বল তো।
মিষ্টিদি বলল, সে তো ঠিকই। কিন্তু কীসের বিপদ হতে পারে? এখানে তো আর কোনও লোকজনই ছিল না।
আমি বললাম, আর টোটোর ড্রাইভার কাকুই বা কোথায় গেল?
মিষ্টিদি বলল, সেই তো। সেটাও তো বুঝতে পারছি না।
বৃষ্টি বলল, এই দিদি চল আমরা মন্দিরের ভিতরে ঢুকে বসে থাকি।
ভুতুমও সায় দিল। মিষ্টিদি বলল, না। বরং আমরা একবার জঙ্গলের দিকে গিয়ে ভালোদাদুর খোঁজ করি।।
আমরা আবার পিছনে সেই বেড়ার ফাঁকটার কাছে এলাম। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে মিষ্টিদি বলল, এখান দিয়ে নামতে পারবি তোরা?
আমি ভালো করে দেখে বললাম, মিষ্টিদি, ওপাশে অনেকটা নীচে জমি। লাফিয়ে নামতে হবে।
মিষ্টিদি বলল, চল তাহলে।
প্রথমে মিষ্টিদিই বেড়ার ফাঁক গলে ওপাশে নামতে গিয়ে তারের এক কোণায় সোয়েটার আটকে পড়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে ভুতুম আর বৃষ্টিকে এক এক করে ধরে নামাল। সবশেষে আমি লাফ দিয়ে নামলাম।
জঙ্গলটা খুব ঘন। কাঁটা ঝোঁপ আর বড় বড় গাছ। বিকেলের ছায়ায় আরও অন্ধকার মনে হচ্ছে। কোনও পথ নেই। তবে লোকজন চলার চিহ্ন আছে। দু’একটা ছোট গাছ ভাঙা। আমরা ছোট ছোট চারটে ডাল ভেঙে লাঠির মতো হাতে নিলাম। সামনে মিষ্টিদি, মাঝখানে ভুতুম আর বৃষ্টি, আমি শেষে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, মিষ্টিদি, আমরা কোথায় যাব? এরপর জঙ্গলে যদি হারিয়ে যাই? রাত্রিবেলায় কী করব আমরা?
মিষ্টিদি বলল, এটা খুব বড় জঙ্গল নয়। একটুখানি চল দেখে আসি। ভালোদাদুকে তো খুঁজতে হবে।
ভুতুম আর বৃষ্টি ভয় ভয় গলায় বলল, যদি খুঁজে না পাই?
মিষ্টিদি বলল, তোরা এত ভয় পাচ্ছিস কেন? ভালোদাদুকে আমরা খুঁজব না?
বলেই মিষ্টিদি ডাকল, ভালোদাদু। আমি, ভুতুম, বৃষ্টি সবাই ডাকলাম। কিন্তু সাড়া পেলাম না। কিন্তু একটা যেন ফোঁস ফোঁস আওয়াজ পেলাম। দু’তিনবার। কেউই বুঝতে পারলাম না কীসের আওয়াজ। আমরা আবার হাঁটতে লাগলাম। মাঝে মাঝে ফাঁকা জমি আর জঙ্গল। চলতে চলতে হঠাৎ ‘মাগো’ বলে পিছিয়ে এল মিষ্টিদি। তাকিয়ে দেখি একটা মোটাসোটা কালো বেজি আমাদের সামনে দিয়ে ডানদিকে চলে গেল। ভুতুম বৃষ্টি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি বললাম, মিষ্টিদি চল ফিরে যাই, এখানে সাপ আছে। বাবা বলে তো যেখানে বেজি থাকে তার কাছাকাছি সাপও থাকে।
মিষ্টিদি বলল, কিন্তু ভালোদাদুকে না খুঁজে চলে যাব? চল না আর একটু এগিয়ে দেখি। সামনে তো একটু ফাঁকা দেখা যাচ্ছে। ওদিক দিয়ে জমির দিকে চলে যাব। তাহলে আর জঙ্গলে ঢুকতে হবে না।
-‘তাই চল।’ আমরা খুব সাবধানে হাঁটতে লাগলাম। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর আমাদের সামনে আড়াআড়ি লোকজন চলার মতো একটা সরু রাস্তা দেখতে পেলাম। কিন্তু রাস্তাটা কোন দিকে যাচ্ছে জানি না। আমরা সেই রাস্তা ধরে ডানদিকে এগোতে লাগলাম। মাঝে মাঝে দূরের হাইরোডে গাড়ি চলার শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু কোনও লোকজনের সাড়া নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি রে মিষ্টিদি?
মিষ্টিদি বলল, জানি না। এখনও ভালোদাদুর খোঁজ পেলাম না। একবার জোরে ডাকি। যদি জঙ্গলে থাকে তবে সাড়া দেবে।
মিষ্টিদির কথা মতো আমরা চারজনে মিলে জোরে জোরে ডাকতে লাগলাম। বেশ কয়েকবার ডাকার পর হঠাৎ ভালোদাদুর গলা, মিষ্টি, বুদ্ধু, ভুতুম তোরা এসেছিস? এদিকে আয়।
আমরা চমকে উঠলাম। ভালোদাদু এখানে? মিষ্টিদি জোরে বলল, তুমি কোথায়?
ভালোদাদু বলল, আচ্ছা তোরা দাঁড়া আমি আসছি।
ভালোদাদুর সাড়া পেয়ে আমাদের ভয় কেটে গেল। আমরা কথা বলতে লাগলাম। একটু পরে দেখি ভালোদাদু একটা বাক্স কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই মিষ্টিদি জিজ্ঞেস করল, বাক্সটা কোথায় পেলে ভালোদাদু?
ভালোদাদু বলল, বলছি, আগে চল একটু ফাঁকায় যাই। ওই ডানদিকে চল।
ভালোদাদুই বাক্সটা নিয়ে হাঁটছে। খানিকটা আসার পর জঙ্গল শেষে ফাঁকা জমি। এখানেও জমিতে আলু গাছ। আমরা জমির আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা এগিয়ে একটু চওড়া মাটির রাস্তা পেলাম। মনে হয় গোরুর গাড়ি চলার রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে আমরা মন্দিরের দিকে এগাতে লাগলাম। সূর্যটা ডুবে গেছে। তবে পুরো অন্ধকার হয়নি। হঠাৎ খেয়াল হল ভালোদাদুর জামা প্যান্টে, বুকচেরা হাফ সোয়েটারে প্রচুর নোংরা লেগে আছে। যেন মাটিতে গডাগড়ি খেয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার জামায় এত কাদা কেন ভালোদাদু?
ভালোদাদু বলল, আর বলিস না, ব্যাটা দু’টোকে ঘায়েল করার জন্য একটু কসরত করতে হল।
মিষ্টিদি বলল, ব্যাটা দু’টো মানে, চোর? কোথায়? আমাদের ডাকলে না কেন?
ভালোদাদু বলল, সে অনেকটা দূরে তো। ডাকলেও তোমরা শুনতে পেতে না দিদিভাই।
মিষ্টিদি বলল, তোমার লাগেনি তো?
ভালোদাদু বলল, না লাগেনি। তোমাদের ভয় করেনি তো?
মিষ্টিদি বলল, ভয় তো করছিল। কিন্তু টোটোর ড্রাইভার মামা কোথায় গেল বলতো?
-‘সেকি! দেবু নেই?’
মিষ্টিদি বলল, না।
আমরা প্রায় মন্দিরের কাছে এসে গেছি। দূর থেকে দেখি টোটোটা দাঁড়িয়ে আছে। ভালোদাদু জোরে ডাকল, এই দেবু, এদিকে আয়।
ডাক শুনে দেবু কাকু ছুটে এসে বাক্সটা নিল। ভালোদাদু জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলি? ওরা বলছে তুই ছিলি না।
দেবু কাকু বলল, হাইরোডের ধারে একটু চা খেতে গিয়েছিলাম।
ভালোদাদু বকলেন,‘ওদের বলে যেতে পারিসনি।’
হাঁটতে হাঁটতে আমরা গেটের কাছে চলে এলাম। তখনই একটা গাড়িও এসে দাঁড়াল। নেমে এলেন সেই পুলিস অফিসার।। সঙ্গে আরও দু’জন পুলিস। ভালোদাদু বলল, আসুন বড়বাবু।
বড়বাবু বললেন, বলুন, হঠাৎ এভাবে ফোন করে দেউলের কাছে ডাকলেন কেন? একেবারে জরুরি তলব। হাইরোডের দিকে পেট্রলিংয়ে ছিলাম, তাই এসে পড়লাম।
ভালোদাদু প্রণামী বাক্সটা দেখিয়ে বলল, আজকেই দেউলের তালা ভেঙে এই প্রণামী বাক্সটা চুরি গিয়েছিল। ঘটনাচক্রে আজকেই আমরা এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। তালা দেখে বুঝলাম টাটকা ভাঙা। তাই খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম।
বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় পেলেন?
ভালোদাদু বলল, এখান থেকে হাফ কিলোমিটারের বেশি হবে, জঙ্গলের মধ্যে। মন্দিরের পিছনের বেড়ার ফাঁক দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই ফাঁক গলে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে এগোতে এগোতে অনেকটা দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা ইঁটের বড় স্তূপের কাছে কিছু ভাঙার শব্দ আর মানুষের গলা পেয়ে কাছে গিয়ে দেখি দু’টো চোর বাক্সটা ভাঙার চেষ্টা করছে। ওরা আমাকে দেখে পালানোর চেষ্টা না করে অ্যাটাক করে। তবে কিছু করতে পারেনি। ছোটবেলার ক্যারাটে শেখাটা কাজে লেগে গেল। এই নিন প্রণামী বাক্সটা, অক্ষতই আছে। তবে…
-‘তবে কী ইন্দ্রনীলবাবু?’
-‘এই বাক্সটা যে মহামূল্যবান তা জানা ছিল না আমার।’
-‘কী আছে এতে।’
-‘এতে কী আছে জানি না। কিছু খুচরো কয়েন থাকতে পারে। তবে তারচেয়ে দামি এই বাক্সটা।’
-‘কেন?’
ভালোদাদু মোবাইলের টর্চ জ্বেলে আলো ফেলল বাক্সটার ওপর। অমনি কালো বাক্সটার গায়ে আকাশের তারার মতো কী যেন চকচক করে উঠল। বাক্সটায় কোনও তালা নেই। তবে চাবি ঢোকানোর মতো একটা ছোট্ট ফুটো আছে। সেইখানটায় এবং বাক্সর ধার চকচক করছে। ভালোদাদু বলল, ‘কতশো বছর আগে এটা তৈরি হয়েছিল জানি না, তবে বহু পুরনো। কারণ আজকের দিনে এমন প্রণামী বাক্স কেউ করবে না। বাক্সটা সম্পূর্ণ রুপো দিয়ে তৈরি। বহু বছরের ময়লা, জল, হাওয়ার রাসায়নিক বিক্রিয়ায় রং পুরো কালো হয়ে গেছে। এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। এটা তো সরকারের সম্পত্তি। আপনি তার ব্যবস্থা করুন।’
-‘আপনি তো মশাই কামাল করে দিয়েছেন। এতযুগ ধরে এইভাবে বাক্সটা সবার চোখের সামনে এখানে পড়েছিল। কেউ বুঝতেই পারেনি!’
-‘আসলে মনে হয় লোহার মতো কালো হয়ে যাওয়ায় ওটার দিকে কেউ সেভাবে নজর দেয়নি। আর এইভাবে দেবতাহীন দেউলে একটা প্রণামী বাক্স রূপোর তৈরি হতে পারে এই ধারণাটাই বা করবে কে? যাক, চোরেদের দৌলতে না হয় সেটাই পাওয়া গেল। কারণ ওরা না নিয়ে গেলে আমরাও একটা কালো বাক্স দেখে চলে যেতাম। ছোটবেলায় তো এই কালো বাক্সই দেখেছি।’
বড়বাবু বললেন, ‘থ্যংক ইউ ইন্দ্রনীলবাবু। আপনি পরপর যে দু’টো কাজ করে দিলেন, পুরস্কারের জন্য আপনার নাম আমি ওপর মহলে সুপারিশ করব।’
ভালোদাদু বলল, ‘আরে না না, ওসব করবেন না। বরং কালকেই আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টকে খবর দিন। কারণ দেউল তো ওরাই দেখভাল করে।’
-‘সেতো বটেই।’
বড়বাবু অন্য পুলিস দু’জনকে বাক্সটা নিতে নির্দেশ দিলেন। ভালোদাদু বলল, ‘বাক্সটা খুব ভারী কিন্তু। অন্তত সাত আট কেজি তো হবেই। ভারী দেখেই হয়তো চোরেরা ভেবেছিল ওর ভেতরে অনেক টাকা আছে। আর সে ব্যাটা দু’টোকে সেখানে পেলেও পেতে পারেন। কারণ যা ওষুধ দিয়েছি তাতে এত তাড়াতাড়ি পালাতে পারবে না। আর আমি মালিকে দেখি। সে তো ঘরের মধ্যে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। সম্ভবত চুরিটা করার আগে মালিকে কিছু খাইয়ে বেহুঁশ করে হাত পা বেঁধে ফেলে রেখে দিয়েছিল। ওকে ওইভাবে দেখেই আমার সন্দেহ বেড়েছিল।’
আমরা সেজন্যই তাহলে মালিকে ওই অবস্থায় দেখেছি। বাক্সটা গাড়িতে রেখে ভালোদাদুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বড়বাবু পুলিস দু’টোকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে গেলেন চোরদুটোর খোঁজে। আর আমরা এলাম মালির কাছে। দেখি মালি ঘরের বাইরে ঝিম ধরে বসে আছে। এরমধ্যে এতকিছু হয়ে গেছে তা সে টেরই পায়নি। ভালোদাদু তাকে সব বলতেই সে চাকরি যাওয়ার ভয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। বলল, দুপুরেবেলায় দু’জন এসে ভাব জমিয়ে আমাকে কী যেন খেতে দেয়। খাওয়ার পর আমার আর কিছু মনে নেই। ভালোদাদু তাকে সান্ত্বনা দিল। তারপর আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ভালোদাদু বলল, কী দিদিভাই, আমাদের বেড়ানো কেমন হল?
মিষ্টিদি বলল, এতো তোমার আর একটা অভিযান হল ভালোদাদু।
হো হো করে হাসল ভালোদাদু। আমরাও সবাই খুব জোরে হাসলাম।
শেষ+++++++(শুরু হল পুজো স্পেশাল গল্প। লিখেছেন গোপাল মিস্ত্রি। আজ দ্বিতীয় কিস্তি। ফি সপ্তাহে চোখ রাখুন …আজ বাংলার সাহিত্যের পাতায়।)
- সন্ধ্যা নামলেই ভূতের আতঙ্কে ভীত সন্ত্রস্ত এলাকাবাসী
- গৃহবধূকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ
- ঝুলন্ত পচাগলা মৃতদেহ উদ্ধার
- সরকারি ভাবে ডেঙ্গু সচেতনতা করলেও প্রদীপের নিচেই অন্ধকার
- খুন হতে হল; বিবাহিত মহিলারা সাথে ভালোবাসার সম্পর্কের কারণে