শতাব্দী প্রাচীন বৈষ্ণব মেলায় পরম্পরা মেনে আজও হয় ‘কন্ঠী বদল’। সাধন সঙ্গীকে চিরতরে কাছে পেতে কেতুগ্রামের দধিয়া বৈরাগ্য তলার গোপাল দাস বাবাজিত মেলায় ভিড় জমান গোঁসাইয়ের দল। সেখানেই একে অপরের মধ্যে মালা-চন্দন পরানোর মাধ্যমে সাধ করা বেছে নেন তাঁদের সাধিকাকে। রবিবার থেকে শুরু হয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্যতম গোপাল দাসের মেলা। লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম হয় মেলাকে ঘিরেই।
কেতুগ্রামের পালিটা পঞ্চায়েতের দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলায় রাধা-কৃষ্ণকে সামনে রেখে সাধন সঙ্গীকে চিরতরে কাছে পেতে কন্ঠী বদল করেন ভিন জেলা থেকে আসা বৈষ্ণব গোঁসাইয়ের দল। ‘কন্ঠী বদল’ বা ‘মালা-চন্দন’ করা বৈষ্ণব সমাজে সাধন সঙ্গীর সঙ্গে চিরতরে বাসা বাঁধার এই নিয়ম। সেই পরম্পরা মেনেই বৈষ্ণব গোঁসাইদের অনেকেই একবিংশ শতাব্দীতেও কেতুগ্রামের দধিয়া বৈরাগ্যতলার পরম বৈষ্ণব সাধক গোপালদাস ব্রজবাসী বা গোপালদাস বাবাজির সাধন পীঠে এসে মাঘ মাসের মাকুড়ি সপ্তমীর পুণ্যতিথিতে কন্ঠী বদল করেন। নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম সহ ভিনরাজ্যের বৈষ্ণব ভক্তদের সমাগম হয় এই মেলায়। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলিত হয় এই মেলায়। এটা সম্প্রদায়-সম্প্রীতির এক নজির তৈরি হয় এই মেলায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পরম বৈষ্ণব গোপালদাস বাবাজি এই মেলার সূচনা করেন। কথিত আছে, ১১৭৬ বঙ্গাব্দে মন্বন্তরে সময় মাধুকরী করতে বীরভূমের কেন্দ্রবিল্ব বা কেঁদুলি পর্যন্ত যান গোপাল দাস বৈরাগ্য। ফিরে এসে দধিয়া বৈরাগ্যতলায় গোপালদাস বাবাজি নিজের সাধন পীঠে কেতুগ্রাম ও বীরভূম এলাকার মানুষের জন্য অন্ন মহোৎসব শুরু করেন। দুর্ভিক্ষের সময় অর্ধাহারে বা অনাহারে থাকা এলাকার গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য এই মহোৎসব মাসাধিকাল চালিয়েছিলেন। সেই মন্বন্তরের স্মৃতিকে জিইয়ে রাখতে আজও মাঘ মাসের মাকুড়ি সপ্তমীতে গ্রামের মানুষ এই গোপালদাস বাবাজির সাধন পীঠে এসে রান্না করে খেয়ে বাড়ি যান। বৈষ্ণব সাধক আউলিয়া সম্প্রদায়ের সন্তরাম আউলিয়ার কাছে দীক্ষা নিয়ে ১১৪৩ সালের এক সময় গোপালদাস ব্রজবাসী দেশ ভ্রমণকালে কেতুগ্রামের দধিয়া গ্রামে তিথু হন। জঙ্গলের মধ্যে রাম-সীতাকে রেখে পুজো অর্চনা করতেন। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্যে রঘুনাথ জিউকে প্রতিষ্ঠা করেন। বর্ধমানের মহারাজা তিলকচন্দ মহতাব এই অতিমানব গোপালদাস বাবাজিকে চিনতে ভুল করেননি। ১১৫২ সালে গোপাল দাস বাবাজির সাধের রাম-সীতা ও রঘুনাথ জিউর মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য ৬৯ বিঘা জমি দান করেছিলেন। বীরভূমের পাকুরহাঁস গ্রামের এক বিত্তবান সহৃদয় ব্যক্তি গোপালদাস বাবাজির এই সাধনস্থলে পুকুর খনন করে দিয়েছিলেন। এই মেলায় এলাকার মানুষের সব প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যেত। শোনা যায়, গোরু, গোরুর গাড়ি, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, এমনকী ঘোড়া ও হাতি এক সময় মেলায় বেচাকেনা করা হতো। কাঠের আসবাব পত্রর, লোহার সামগ্রী, মাটির তৈজস পত্র সহ গৃহস্থালীর খুঁটিনাটি আজও বিক্রি হয়। মেলাকে ঘিরে যেমন বৈষ্ণব ভক্তদের আগ্রহ তেমনই এলাকার বাসিন্দাদের। সংসারের ব্যবহৃত প্রায় সব সামগ্রী মেলায় এখনও পাওয়া যায়।পরম্পরা ও রীতি মেনে আজও দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলা তার জনপ্রিয়তা হারায়নি।
মঙ্গলকোটের ভাল্যগ্রামের বাসিন্দা কৃষ্ণকিশোর চৌধুরী কেতুগ্রামের বাসিন্দা হারাধন সাহা বলেন, আমরা দীর্ঘবছর ধরে এই মেলায় আসি। আখড়া নিয়ে থাকি। আমাদের বিশ্বাস মেলায় এলে গোপাল দাস বাবাজি আমাদের মনোস্কামনা পূর্ণ করেন। পাশাপাশি এদিন কণ্ঠী বদল করা পাণ্ডুগ্রামের বাসিন্দা সদানন্দ দাস বাবাজি এবং কৃষ্ণাদাস বাবাজি বলেন, আমরা মালা-চন্দন করে কন্ঠী বদল করি এই মেলায় এসে। আমাদের বিশ্বাস এখানে কন্ঠী বদল করলে আমরা বাকী জীবন ভালোভাবেই কাটাতে পারব। এদিকে কান্দি রাজ কলেজের অধ্যাপক তথা গবেষক ড. তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এই মেলার বিরল দৃশ্য হল কন্ঠী বদল। সাধক-সাধিকারা একে অপরের সঙ্গী হন এই মেলায়। খুব প্রাচীন এই মেলার গুরুত্ব অনেক। তবে এখন কন্ঠী বদল অনেক কমে গিয়েছে বলে জানান কমিটির সদস্যরা।