আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আমরা কেবল একটা গাছ লাগিয়ে ক্ষান্ত। কিন্তু একটা গোটা স্কুল বছরের পর বছর পরিবেশ বাঁচাতে লড়াই করে চলেছে, আজ তেমনই এক স্কুলের গল্প শোনাবো। ঠিক গল্প নয়, ভারতবর্ষের এক চলমান স্কুলের কথা। সব বাধা ধরার গন্ডি পেরিয়ে পড়াশোনা ও হাতে কলমে শিখে নেওয়ার জায়গা বলা যায়। এই স্কুলের বেতন টা কিন্তু ভারী অদ্ভুত। স্কুলে পড়াশোনা করার খরচ বলতে একটাই, তাহল বর্জিত প্লাস্টিক দ্রব্য। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্য, এমনই এক অভিনব স্কুল রয়েছে আমাদের ভারতবর্ষে।
স্কুলের বেতন দেওয়ার দিন। গুয়াহাটির দীপর বিল ঘেঁষা পামহির ‘অক্ষর’ স্কুলে ছাত্রছাত্রীর দল তাই পিঠে স্কুল ব্যাগ আর হাতে বেতনের ‘থলে’ নিয়ে স্কুলে সারিবদ্ধ। থলের ভিতরে টাকা-পয়সা নয়, আছে চারপাশে কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিকের প্লেট, বোতল, খেলনা, কৌটোর মতো বিভিন্ন বর্জ্য! অক্ষরের নিয়মই তো তাই। এই স্কুলে লেখাপড়ার জন্য জমা দিতে হয় প্লাস্টিক! এখানে পড়াশোনা করতে গেলে আলাদা করে কোন রকম খরচ লাগে না। অবশ্য ভারতবর্ষে অজস্র অবৈতনিক স্কুল রয়েছে কিন্তু তাদের মধ্যেও এই স্কুলটি অভিনব। কারণ একটাই, স্কুল অবৈতনিক হলেও স্কুলে পড়াশোনা পড়ার জন্য পড়ুয়াদের সপ্তাহে অন্তত পক্ষে ২৫ টি প্লাস্টিক দ্রব্য জমা দিতে হয়। স্কুলের প্রকৃতিও আর পাঁচটা স্কুলের থেকে আলাদা। বাঁশের ছাদের নিচে খোলামেলা পরিবেশে ক্লাস করেন পড়ুয়ারা। এই স্কুলে বয়স ভিত্তিক কোনরকম ক্লাস বিভাজনের ব্যবস্থাও নেই।
এই অভিনব স্কুলের পরিকল্পনা দুইজনের মস্তিষ্কপ্রসূত। যাদের পরিকল্পনাতেই লুকিয়ে রয়েছে স্কুলের গঠন থেকে পড়ুয়াদের ও প্রকৃতির ভবিষ্যৎ। পারমিতা শর্মা এবং মাজিন মুখতার এমন স্কুলের পরিকল্পনা করেন। হঠাৎ করে এমন স্কুলের পরিকল্পনা কেন? ২০১৩ সালে মাজিন নিউইয়র্ক থেকে ভারতে আসেন একটি অন্য স্কুলের প্রজেক্ট নিয়ে। সে সময়ই তার সঙ্গে পরিচিয় হয় পারমিতার। পারমিতা সেসময় টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সে সামাজিক কাজ নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছেন। তারপর দুজনের মধ্যেই ইচ্ছা হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে কোন কাজ করার। তারপর দুজনে মিলে আসামের পামোহিতে ‘অক্ষর’ নামের স্কুলের স্বপ্ন দেখলেন। অদম্য ইচ্ছা থেকে দ্রুত সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেও ফেললেন। তারপর আর ইনাদের পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধুই উত্তরণের গল্প।
দীপর বিলের আশপাশে বিস্তর পাথর খাদান। সেখানে বাবা-মায়ের পাশাপাশি বাচ্চারাও কাজ করে। তাদেরই প্রথম স্কুলে টানার চেষ্টা করেন মাজিন-পারমিতা। ২০১৬ সালে ২০ জনকে নিয়ে একটি খোড়ো চালায় শুরু হয় এই ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক’ স্কুল। মূল উদ্দেশ্য ছিল, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার মধ্যে সেতুবন্ধন করা। মাজিন ও পারমিতার কথায়, স্থানীয় ছেলেমেয়েদের পাথর ভাঙার রোজগার বন্ধ করে স্কুলে টানা সহজ ছিল না। তাদের জন্য বিশেষ সময়ে, বিশেষ বৃত্তিমুখী পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হয়। বোঝাতে হয় অভিভাবকদের। বয়সের ভিত্তিতে নয়, অক্ষরে অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও জ্ঞানের ভিত্তিতে ক্লাস ভাগ করা হয়।
এইভাবে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সামনে পড়াশুনোকে তুলে ধরা কাজটা সহজ ছিল না তা সকলেরই অনুমেয়। কারণ তাদের কাছে পড়াশুনোর থেকে পেটের ভাতটা আগে। এই এলাকায় স্কুল চালানোর জন্য জন্য নেওয়া যাবে না কোনো পড়াশোনার খরচ, সেই সঙ্গে দুজনকে ভাবাচ্ছিল এলাকার দূষণ। এলাকার বাসিন্দাদের অধিকাংশই শীতের হাত থেকে বাঁচতে প্লাস্টিকের বর্জ্য পদার্থ পুড়িয়ে উষ্ণতার খোঁজ করে। এরফলে পরিবেশও ভীষন দূষিত হতে থাকে। তাই তারা দুজনে ঠিক করে স্কুলে পড়াশুনার ফিজ হিসাবে প্লাস্টিকের বর্জ্য জোগাড় করার পরিকল্পনা। আর তাতেই মিলেছে সাফল্য। আর পড়াশোনার সাথে সাথেই সেই সকল বর্জ্যপদার্থ থেকে প্রয়োজনীয় নানান সামগ্রীও বানাতে শিখেছি পড়ুয়ারা।
নিকটবর্তী খাদানে কাজ করে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া যায় দৈনিক হিসাবে। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু হয় স্কুলের পুরাতন পড়ুয়ারা নতুনদের প্লাস্টিক দ্রব্য থেকে নানান জিনিস তৈরি করা শেখাবে। তার বিনিময় তারা পাবে খেলনা টাকার নোট। সেই খেলনা টাকার নোট দিয়ে করা যাবে অনলাইন শপিং। শুধু তাই নয় পড়ুয়ারা যদি সেই খেলনা টাকা দিয়ে স্কুল থেকে সত্যিকারের টাকাও নিতে পারে। স্কুল শুরু হয়েছিল মাত্র কুড়িটি বাচ্চাকে নিয়ে, যা বর্তমানে সংখ্যা ছাড়িয়েছে একশোর বেশি। চার থেকে ১৫ বিভিন্ন বয়সের পড়ুয়ারা নিয়মিত স্কুলে আসে পড়াশোনা করতে। দুই তরুণ-তরুণীর দেখা স্বপ্ন ধীরে ধীরে ডানা মেলেছে। ধীরে ধীরে ওই দারিদ্র এলাকায় শিক্ষার আলো দেখছে ছোট ছোট শিশুরা। আর এভাবেই চলতে থাকলে আগামী প্রজন্মও একইভাবে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে। পারমিতা ও মাজিন দুজনেই বদ্ধপরিকর শিক্ষার আলোকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে।