যাঁর জীবনে যত সাফল্য, তাঁর লড়াই-সংগ্রাম-ত্যাগ ততটাই বেশি। এই যে স্বামীজির শিকাগো-সাফল্য আজ আমরা যততা সহজে ঘরে বসে মুল্যায়ন করছি, তাঁর ওই আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চে প্রথম দশে জায়গা পাওয়ার আগের মাসকয়েকের লড়াই খুবই কঠিন এবং কষ্টকর ছিল।
রাজস্থানের শেখাওয়াত রাজবংশের ক্ষেত্রীয় মহারাজের অনুরোধে বিবেকানন্দ নাম দিয়ে আমেরিকা যাবেন বলে জাহাজে চড়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৮৯৩ সালের ৩১ মে মুম্বই থেকে পেনিনসুলার জাহাজে চড়ে রওনা দিলেও মাঝপথে জাপানে নেমে পড়েন তিনি। প্রথমে কোবি বন্দরে নেমে পরে সড়কপথে কিওটো, ওসাকা, টোকিও দেখে ফের জাহাজে চেপে জাহাজে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার যাত্রা করেন। এই জাহাজে তাঁর সহযাত্রী ছিলেন মুম্বইয়ের প্রখ্যাত শিল্পপতি জামশেদজি টাটা। ভ্যাঙ্কুভার থেকে তিনবার ট্রেন পাল্টে যখন শিকাগো পৌঁছান তখন স্বামীজি কার্যত কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন। এখানেই শেষ নয়, শিকাগো পৌঁছে শোনেন, ধর্ম মহাসম্মেলন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নাম রেজিস্ট্রেশন করানোর শেষ তারিখও চলে গিয়েছে। পরের মহাসম্মেলন শুরুর জন্য আরও কয়েকমাস অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু পকেটে অর্থ খুবই কম থাকার কারনে তিনি শিকাগো ছেড়ে কম খরচে দিন কাটানোর শহর বোস্টনে চলে গিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকেই যোগাযোগ করে পরিচয় হয় প্রখ্যাত আমেরিকান পন্ডিত অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সঙ্গে। এই রাইটকে আজও মার্কিন মুলুকের শিক্ষাবিদরা এনসাইক্লোপেডিক হিসাবে সম্মান করেন। তখনও তাঁর বিরাট প্রভাব ছিল গোটা আমেরিকায়। এই রাইটই স্বামীজিকে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি নিজে সম্মেলন কতৃপক্ষকে একটি চিঠি লেখেন। তাতে বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ সম্পর্কে ভুমিকা লিখতে গিয়ে যে শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তা আজও ভারতবাসী হিসাবে আমাদের সকলের গর্ব হয়।
নরেন্দ্রনাথ দত্তের মেধা ও অনুধাবন ক্ষমতা সম্পর্কে সেদিন রাইট লিখেছিলেন, “আমাদের দেশের সমস্ত পন্ডিত অধ্যাপকদের পাণ্ডিত্যের সমষ্টির চেয়ে ইনি (স্বামী বিবেকানন্দ) অনেক বেশি পাণ্ডিত্যের অধিকারী।’’ এই এক চিঠিতেই ধর্ম মহাসম্মেলনের মঞ্চে প্রথম দশ জনের মধ্যে হিন্দু ধর্মের তরফে এক বক্তা হিসাবে বসিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণের শিষ্যকে।২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলেছিল শিকাগোর সেই ধর্ম মহাসম্মেলন। স্বামীজি তারপর বেশ কয়েকবার বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন।
প্রতিবারই প্রেক্ষাগৃহ ‘হাউসফুল’ থাকত তা-ই নয়, উপচে পড়ত ভির। আগে থাকতে সবাই জেনে নিতেন, কবে কোন স্টেশনে, ক’টায় কলকাতার এই ‘পাগড়ি পরা’ সৌম্যদর্শন সন্ন্যাসী বক্তব্য রাখবেন। বিদেশিদের লেখা একাধিক গ্রন্থে উল্লেখ পেয়েছি, অনেক আগে থেকে সবাই এসে মঞ্চের সামনের দিককার আসনে বসার জায়গা নিতেন। সকলে এই গ্রিক ভাস্কর্যের মতো মুখমন্ডলের গেরুয়া পাগড়ি পড়া সন্ন্যাসীর কথা শুনতে চাইতেন। শুধু প্রেক্ষাগৃহ নয়, বাইরেও যেখানে তিনি যাচ্ছিলেন সেখানেই তাঁকে ঘিরে জনতার বলয় তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। আর এটাই ছিল এক বাঙালির সাগরপাড়ে পা রেখে মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সনাতন ধর্মের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে বিশ্বজয়ের ঐতিহাসি ঘটনার প্রেক্ষাপট।