ফিচার

ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে দেশের ক্ষতি করার এক স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রকারী উমিচাঁদ

উমিচাঁদ: এক প্রতারিত বণিকের কাহিনি

গঙ্গার তীরে কলকাতার আকাশ তখনো ধোঁয়া আর ধুলায় ঢাকা। ইউরোপীয় জাহাজগুলোর ভিড়, বণিকদের ভাঙা বাংলো, বাজারের কোলাহল—সবকিছু মিলে শহরটা যেন এক নতুন সাম্রাজ্যের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। সেখানেই বাস করতেন এক হিন্দু বণিক—উমিচাঁদ।

আগ্রা থেকে আগত এই মানুষটির চোখে ছিল দুঃসাহস আর ব্যবসায়িক বুদ্ধি। প্রথমে বিষ্ণুদাস শেঠের ছত্রছায়ায় কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে আফিং, সোরা আর দাদনি ব্যবসায় এমনভাবে কর্তৃত্ব গড়ে তুললেন যে কলকাতার অভিজাত বণিকদের তালিকায় শীর্ষে উঠে এলেন। মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর নাম মানে ছিল প্রভাব, ক্ষমতা আর বিপুল ধনসম্পদ।

উমিচাঁদ জানতেন, ধনসম্পদ একা টিকে থাকতে পারে না, দরকার রাজনীতি। তাই নবাবের অমাত্যদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক, খবরদারি, গোপন দান—সবকিছু চলতে লাগল সমান্তরালে। ইংরেজরা শিগগিরই বুঝল, এই বণিক ছাড়া তারা দরবারে পা রাখতে পারবে না। ক্লাইভ আর ওয়াটসের চোখে উমিচাঁদ হয়ে উঠলেন এক অমূল্য সহযোগী।

ক্লাইভ যখন সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা আঁটছিলেন, তখন উমিচাঁদ প্রতিদিন দরবারে গিয়ে খুঁটিনাটি সংবাদ সংগ্রহ করতেন। তিনি চাইতেন ইয়ার লতিফকে নবাব বানাতে, কারণ দুর্বল মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। কিন্তু ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত মীরজাফরকে বেছে নেয়। উমিচাঁদের পরিকল্পনা ভেঙে পড়ে, তবুও তিনি ষড়যন্ত্রের সঙ্গেই থেকে গেলেন—কারণ তাঁর চোখ তখন শুধু এক জায়গায়, স্বার্থের বিশাল অঙ্কে।

“যদি বিপ্লব সফল হয়,” তিনি দাবি তুললেন, “নবাবের ধনভাণ্ডারের পাঁচ শতাংশ আমার হাতে আসতে হবে।”
ক্লাইভের শিবিরে এই কথা শুনে সবার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। এমন স্পষ্ট লোভ আর কাউকে এতখানি নগ্নভাবে প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।

অবশেষে ইংরেজরা ফাঁদ পাতল। তৈরি হলো দুটি কাগজ—একটি লাল, একটি সাদা। লাল কাগজে লেখা হলো উমিচাঁদের প্রাপ্য, যা আসলে কেবলই দেখানোর জন্য। আসল কার্যকরী দলিল ছিল সাদা কাগজ, যেখানে তাঁর নামের ছিটেফোঁটাও নেই।
যখন সত্য প্রকাশ পেল, উমিচাঁদের চোখ শূন্য হয়ে গেল। তাঁর ঠোঁট কাঁপছিল, মুখ থেকে রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিল। রবার্ট অরম লিখেছেন, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন—এক ধনী বণিকের জীবনের সবচেয়ে অপমানজনক মুহূর্তে।

এরপর থেকে তিনি আর কিছুই করতে পারলেন না। ক্লাইভ তাঁকে উপেক্ষা করলেন, ইংরেজরা তাকে বর্জন করল, আর মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর প্রভাব ধুলোয় মিশে গেল। নিঃসঙ্গতা, মানসিক ভগ্নতা আর অপমান তাঁকে ধীরে ধীরে গ্রাস করল। একদিন তিনি নিভে গেলেন—যেমন নিভে যায় মোমবাতি, তবু ধোঁয়া থেকে যায় কিছু সময় বাতাসে।

উমিচাঁদ ছিলেন না কোনো মুক্তিকামী বীর, আবার নিছক খলনায়কও নন। তিনি ছিলেন ধনলোভে অন্ধ এক বণিক, যিনি রাজনীতির খেলায় নিজের স্বার্থ খুঁজতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতারণার শিকার হয়ে গেলেন। পলাশির ষড়যন্ত্রে তাঁর নাম তাই আজও বেঁচে আছে—এক প্রতারিত বণিকরাজ হিসেবে।ভারতে বঙ্গ নবাবী আমলের এক আদি ব্যবসায়ী এবং যিনি নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান হোতা ছিলেন এবং ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের আগে রবার্ট ক্লাইভের সাথে আলোচিত চুক্তির সাথে যুক্ত ছিলেন।

Loading

Leave a Reply