ফিচার বিশ্ব

বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেলে তিনদিন কাটানো এক নাবিকের অনুভূতি।

বাংলাদেশের এক নাবিক লিখছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।

“বার্মুডা ট্রায়াংগেল” এ আমার ৩ দিন……!!!

হেডলাইনটা দেখেই হয়তো চমকে উঠছেন।অবশ্য চমকাবারই কথা।কেননা মুটামুটি শিক্ষিত যে কেউই এই জায়গাটা নিয়ে নানান রকম গল্প শুনে বড় হয়েছেন,নিজে থেকেও করেছেন নানান কল্পনা-জল্পনা। আজকে সেই বার্মুডা ট্রায়াংগেল নিয়ে আমি আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করব…..

 

প্রথমেই এই ত্রিকোণাকার জায়গাটার অবস্থানটা ক্লিয়ার করি।আ-মেরিকার “ফ্লোরিডা”,ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের “পুওর্তো রিকো” এবং “বার্মুডা”…. এই তিনটি জায়গা যোগ করলে ত্রিভুজ আকৃতির যে জায়গাটা হয়,সেটিকেই মূলত বার্মুডা ট্রায়াংগেল বলা হয়।এটি উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত। সাধারণত ল্যাটিন আ-মেরিকা,পানামা অথবা মেক্সিকো থেকে কোন জাহাজ আ-মেরিকার পূর্ব ভাগে যাওয়ার সময় এই ট্রায়াংগেলটা পারি দিতে হয়।আমিও ব্রাজিল থেকে এই রুট হয়েই আ-মেরিকার বাল্টিমোরে গিয়েছিলাম।তবে এখন সেটা নিয়ে কিছু বলছি না।বরং এই ট্রায়াংগেলের ভেতরে জাহাজ নিয়ে ” ৩ দিন” ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করছি….।

 

আমরা বাল্টিমোর পোর্টের বাইরে নোঙর করে ছিলাম।কেননা পরবর্তী গন্তব্য ঠিক হয়নি।কিন্তু আ-মেরিকার আওতাধীন সাগরে থাকলে জাহাজে অনেক দামী লো-সালফার ফুয়েল ব্যাবহার করতে হয়।এতে পরিবেশ কম দূষিত হয়।৭ দিন অপেক্ষার পর কোম্পানি অর্ডার করলো(খরচ বাচাতে),আমরা যেন ২০০ নটিক্যাল সাগরের ভেতরে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে কোম্পানির পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করি।যেই কথা সেই কাজ….।আমরা চলে গেলাম উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ভেতরে।জাহাজের ভাষায় এটাকে ড্রিফটিং বলা হয়।বলে রাখি,পৃথিবীর উত্তাল সাগরের মধ্যে উত্তর আটলান্টিক অন্যতম। কয়েকদিন পর পর একটা করে নিম্নচাপ এসে আমাদের অবস্থা নাজেহাল করে যেতো। আবার দু’একদিন ভালো,পরে আবার রোলিং-পিচিং! ইঞ্জিন বন্ধ থাকলেও বাতাস,ঢেউ এবং স্রোতে ভেসে আমাদের জাহাজ প্রতিদিন প্রায় ৭০-৮০ মাইল করে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে এগোতে থাকে।এভাবে যেতে যেতে আমরা চলে যাই বার্মুডা ট্রায়াংগেলের ভেতরে!!!

 

আমি সেকেন্ড অফিসার এবং ক্যাপ্টেনকে বললাম, কোন সমস্যা হবে না স্যার? উনারা অনেক হাসাহাসি করলেন।বললেন, “এগুলো আ-মেরিকার বানানো গল্প!আসলে কিছুই না”।যাইহোক, তবুও মনে একটা ভয় ভয় কাজ করতো। ভয়ের আরেকটা কারণ ছিলো খারাপ আবহাওয়া! ওখানে বাতাসের গতিবেগ ছিলো ঘন্টায় প্রায় ৮০ কি.মি. এবং ঢেউ এর উচ্চতা ছিলো ১৫-১৮ ফুটের মতো! এর মাঝে সেকেন্ড অফিসার একদিন বললেন, গত দুই দিন ওয়েদার আপডেট এর কোন মেসেজ আসছে না!এটা শুনে ভয় আরও বেড়ে গেল!কেননা তখন আমি অনেক জুনিয়র ছিলাম।অত:পর ১৭ দিন পর আমরা সেখান থেকে ফ্রান্স এর উদ্দেশ্যে রওনা হই।

 

এখন আসি আসল কথায়…..

আসলে জাহাজের অফিসারদের কথাই ঠিক।বার্মুডা ট্রায়াংগেলের ওসব গল্পের কোন ভিত্তি নেই!যেসব বিমান এবং জাহাজ দুর্ঘটনার কথা আমরা শুনি,ওগুলো অনেক বছর আগের।তখন প্রযুক্তি ততোটা উন্নত ছিলো না।কাজেই উত্তর আটলান্টিকের বিশাল ঢেউ আর বাতাসের কাছে ওসব জাহাজ টিকে উঠতে পারেনি।আর ম্যাপে তাকালে দেখবেন বার্মুডার আশেপাশে আর কোন দেশ নেই।কাজেই সিগনাল স্টেশন না থাকায় জাহাজগুলো আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেতো না,যার দরুন উত্তাল ঢেউ সেগুলোকে খুব সহজেই ঘায়েল করে নিতো!এমনকি এখনো ওদিকের সিগনাল স্টেশন তেমন একটা সক্রিয় না,তাই Navtex এ মাঝে মাঝে মেসেজ আসে না।যদি এটা আসলেই বিপদজনক হতো, তাহলে এই জায়গাটা আমাদের জন্য ” রেড জোন” করে দিতো।আমরা জাহাজে যে ম্যাপ ব্যাবহার করি,সেটা কতটা নিখুঁত তা কেবল আমরাই জানি।ধরেন, ৩০ বছর আগে একটা জাহাজ ডুবেছে….কাজেই সেই জায়গার গভীরতা একটু কমেছে। এটাও আমাদের ম্যাপে সুস্পষ্টভাবে মার্ক করা থাকে।এছাড়া এসব ম্যাপ প্রতি সপ্তাহে আপডেট করা হয়!কাজেই বুঝতেই পারছেন যে,সো কল্ড বার্মুডা ট্রায়াংগেল যদি আসলেই বিপদজনক হতো তবে তা অবশ্যই আমরা এড়িয়ে চলতাম।

যাইহোক, আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে বার্মুডা ট্রায়াংগেলে আধ্যাত্মিক কোন ব্যাপার নেই।ভৌগোলিক ভাবেই সেখানকার সাগরটা অনেক উত্তাল থাকে(বিশেষ করে শীতকালে)।আর আকাশের অবস্থাও খারাপ থাকায় এবং নিকটবর্তী কোন কন্ট্রোল টাওয়ার না থাকায় প্লেনের পাইলটও পথ হারিয়েছিলেন। হঠাৎ করে পানি সরে গিয়ে গর্ত হয়ে যাওয়া,এলিয়েন ল্যান্ড করা,কম্পাস কাজ না করা…..ইত্যাদি সবই গুজব!

Loading

Leave a Reply