নিজস্ব প্রতিনিধি, আরামবাগ ,প্রীতম পাল
আরামবাগ শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার উত্তরে তিরোল গ্রাম। একসময় জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চল ছিল ডাকাতদের আখড়া। সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে সবকিছু ঝকঝকে রাস্তা, বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত চারপাশ, আর তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন চক্রবর্তী পরিবারের খ্যাপা কালী মন্দির।প্রায় ছ’শো বছর আগে জমিদার দীননাথ চক্রবর্তী স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই নিয়ম মেনে চলে আসছে সিদ্ধেশ্বরী বা খ্যাপা কালী পুজো। তবে এই মন্দিরের খ্যাতি শুধু পুজোর জন্য নয় এখানকার ‘লোহার বালা’ নিয়েই জড়িয়ে রয়েছে অগণিত কাহিনি ও বিশ্বাস।
কথিত আছে, মা সারদা দেবী একবার তাঁর পরিবারের সদস্যদের তিরোলের চক্রবর্তী বাড়ির খ্যাপা কালীর বালা আনতে বলেছিলেন। ভক্তদের বিশ্বাস, এই বালা পরলেই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই অলৌকিক কাহিনিই অনুপ্রাণিত করেছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-কে তিনি এই বালাকে ঘিরে একটি গল্পও লিখেছিলেন।প্রতি বছর কার্তিক মাসের ভূত চতুর্দশী-র সময় উপচে পড়ে ভক্তদের ভিড়। বিশ্বাস, মা খ্যাপা কালীর রূপ যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনই করুণাময়।
চক্রবর্তী পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের পুরোহিত নির্মাল্য চক্রবর্তী জানান,
প্রতিদিনই মায়ের নিয়মিত পুজো হয়, তবে কার্তিক মাসে বিশেষ পুজোপাঠের আয়োজন থাকে। ধনিয়াখালির বিশ্বাস বাড়ি থেকে প্রতি বছর মায়ের মুকুট আসে।
আরেক পুরোহিত কাজল চক্রবর্তী বলেন,বাবা মারা যাওয়ার পর আমি পুজোর ভার নিয়েছি। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী প্রতি বছর নির্দিষ্ট এক গ্রাম থেকে সানাই বাদকরা আসেন। তাঁরা পারিশ্রমিক নেন না এটা মায়েরই ইচ্ছা।
মন্দিরের পরিবেশও যেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা। দিন-রাত ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে, বিশেষ করে মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষদের। কেউ পরিবারের সদস্যকে নিয়ে আসেন, কেউ আত্মীয়কে। বিশ্বাস একটাই — “
মা খ্যাপা কালী সুস্থ করবেন।
প্রচলিত আছে, রোগীকে মন্দিরের পিছনের পুকুরের ডুব দিয়ে ‘পুজো করা লোহার বালা’ পরানো হয়। সুস্থ হয়ে উঠলে সেই বালা খুলে আবার মন্দিরে ফিরিয়ে দিতে হয়।
শুধু হুগলি নয় বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, নবদ্বীপ, ২৪ পরগনা— এমনকি রাজ্যের বাইরে থেকেও আসেন অসংখ্য মানুষ। কেউ মন্দির প্রাঙ্গণে রাত কাটান, কেউ আশপাশের বাড়িতে ভাড়া নিয়ে পুজো দেন।
ভক্ত মিঠু কর্মকার বলেন,আমার মা মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। গত বছর বালা পরানোর পর অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাই এ বছর আবার এসেছি।
আরেক ভক্ত সুনিতা হেমরম জানান,
শুনেছিলাম এখানে কালী মা খুব জাগ্রত। মেয়ের সমস্যার জন্য এসেছি। মায়ের উপর অগাধ বিশ্বাস।
আজকের দিনে, যখন বিজ্ঞান ও চিকিৎসা অনেক এগিয়েছে, তবুও তিরোলের এই মন্দিরে মানুষের বিশ্বাস অটুট। শতাব্দী পেরিয়েও খ্যাপা কালী মন্দির আজও মানুষের মনে অলৌকিক আস্থার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
![]()




