ফিচার

রবি ঠাকুরের কিছু অজানা গল্প

১৮৯৮ সালের কলকাতা। শহরের অলিগলিতে তখনও রিকশার টুংটাং শব্দ, হাতে গামছা বাঁধা ঠেলাগাড়ি টেনে ছেলেরা দৌড়চ্ছে। চারদিকে ইংরেজদের বিলাসবহুল গাড়ি, আবার কোথাও মাটির ঘরে বসা বাঙালি পরিবারের হাহাকার। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই সরলা দেবী চৌধুরাণী জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছেন—

“দেশ জাগছে, পুরুষেরা বিপ্লব করছে, গান গাইছে। কিন্তু নারীরা? তারা কি এখনও শুধু আঁচলের আড়ালেই বন্দি থাকবে?”

তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল শিবানীর মুখ। শিবানী—একসময়ের হাসিখুশি মেয়ে, আজ বিধবা। স্বামী মারা গিয়েছে হঠাৎ অসুখে। শ্বশুরবাড়ি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। হাতে একটিও টাকা নেই। বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছে মাথা নিচু করে।

সেদিন শিবানী যখন কাঁদছিল, সরলার বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠেছিল। “নারীরা কেন এমন অসহায় হবে? কেন তারা নিজের ভাগ্যের ওপর নিজের অধিকার রাখবে না?”

সরলা জানতেন, নারীর মুক্তি শুধু বিদ্যাভ্যাসে নয়—অর্থনৈতিক স্বাধীনতাতেও লুকিয়ে। আর সেই কারণেই জন্ম নিল তাঁর মনের শিশুটি—“লক্ষ্মীর ভাণ্ডার”।

এক শীতের বিকেলে তিনি আশপাশের মহিলাদের ডাকলেন। কেউ ছিলেন নবাবি পরিবারের বউ, কেউ শিক্ষিত, কেউ আবার সধবা। সবাই বসেছে মাদুরে। সরলা শান্ত গলায় বললেন—

“বোনেরা, আমরা আজ যা করতে যাচ্ছি, তা ছোট মনে হলেও একদিন মহীরুহ হবে। আমরা প্রত্যেকে যদি মাসে এক আনা, দু’আনা করে জমাই, তাহলে গড়ে উঠবে এক ভাণ্ডার। নাম দেব ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’—যে ভাণ্ডার হবে আমাদের শক্তির প্রতীক।”

প্রথমে হাসি, খিলখিল, গুজব।

“দিদি, গৃহস্থালির খরচ মিটিয়ে হাতে পয়সা থাকে নাকি!”—কেউ বলল।

“আমাদের সঞ্চয় করেই বা কী হবে?”—অন্য কেউ যোগ করল।

সরলা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর গলা দৃঢ়—

“আজ তোমরা যেটাকে তুচ্ছ ভাবছ, কাল সেটা জীবন বাঁচাবে। স্বামী নেই, ভাই নেই, এমন দিন যদি আসে? তখন তোমার নিজের হাতে থাকা এই সঞ্চয় হবে মুক্তির আলো। শিক্ষা ও সঞ্চয়—এই দুই শক্তি ছাড়া নারী কখনো স্বাধীন হবে না।”

এই কথাগুলো যেন জাদুর মতো কাজ করল। কেউ এক আনা, কেউ দু’আনা হাতে তুলে দিল। সেই টাকাগুলো রাখা হল একটি ছোট্ট কাঠের সিন্দুকে। সিন্দুকে লাল রঙের কাপড় জড়িয়ে তাতে লিখে দেওয়া হল—“লক্ষ্মীর ভাণ্ডার”

মাস যেতে শুরু করল। প্রতি সপ্তাহে মহিলারা আসত সরলার বাড়ি। শুধু টাকা জমাতে নয়, গল্প করতে, গান গাইতে, নিজেদের কষ্ট শেয়ার করতে। এই ভাণ্ডার হয়ে উঠল শুধু সঞ্চয়ের জায়গা নয়—এটি ছিল আত্মবিশ্বাসের অঙ্গন।

কেউ শিখল সুতো দিয়ে পুতুল বানানো, কেউ শিখল ফুল দিয়ে গয়না তৈরি। সরলা বলতেন—

“দেখো, সঞ্চয় আর কাজের দক্ষতা—দুটো থাকলে কোনো নারী পরের দয়ার পাত্র হবে না।”

এভাবে ধীরে ধীরে সেই সিন্দুকের ভেতর জমল রূপোর গুঁড়ো, ছোট সোনার চুড়ি, আর পয়সার ঝনঝনানি।

শিবানীও প্রতি সপ্তাহে আসত। তার চোখে ছিল অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে বলত—

“দিদি, আমি একদিন নিজে কিছু করব। অন্য কারও মুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচব না।”

বছর দুই পর, শিবানী এল সরলার কাছে। হাতে নতুন শাড়ি, গলায় সামান্য হাসি।

“দিদি, আজ আমি কারখানা খুলেছি। মহিলারা সেখানে পুতুল বানায়, ফুলের মালা গাঁথে। এই টাকা দিয়ে সব শুরু করলাম।”

সে কাঠের সিন্দুকের দিকে তাকিয়ে বলল—

“এই ভাণ্ডার শুধু আমার জীবন নয়, আমার আত্মসম্মানও ফিরিয়ে দিয়েছে।”

সরলার চোখে জল এল। তিনি বুঝলেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার শুধু টাকা জমার জায়গা নয়—এটি স্বপ্ন জমার জায়গা। এখানে জমছে নারীর শক্তি, সাহস আর মুক্তির আলো।

একদিন সভায় দাঁড়িয়ে সরলা বললেন—

“বোনেরা, এই ভাণ্ডার আমাদের প্রতীক। আমরা যদি চাই, তবে সংসারের চার দেওয়ালের বাইরে আলো ছড়িয়ে দিতে পারি। শিক্ষা, সঞ্চয় আর ঐক্য—এই তিনে নারী মুক্তি।”

সেই দিন উপস্থিত শতাধিক নারী হাততালি দিল। কাঠের সিন্দুকের উপর গন্ধরাজের মালা রাখা হল। সরলা দেবীর কণ্ঠে দৃঢ় উচ্চারণ—

“এই ভাণ্ডার একদিন শুধু ঘরের গণ্ডিতে থাকবে না। এটি হয়ে উঠবে সমগ্র দেশের নারীর মুক্তির মন্ত্র।”

সেই স্বপ্ন আজও বেঁচে আছে। সরলা দেবীর সেই ছোট্ট সিন্দুকের গল্প আজ ইতিহাসের অমূল্য অধ্যায়।।

©️✒️ সুমিত নন্দী।

তথ্য – অক্সফোর্ড ডিকশনারি অফ ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি🎓

Loading

Leave a Reply