ফিচার

উচ্চতা কমছে প্রতিমার। মাথায় হাত শিল্পীদের।

আনন্দময়ীর আগমনে মুখরিত হত সব দিক। কিন্তু এবছর সেই আনন্দময়ী রূপকারদের আনন্দ কোথায়? এক করোনায় কুপোকাত সব। কাজকর্ম বন্ধ সেইসঙ্গে কমেছে রোজগার। তাই টান পড়েছে বাজেটেও। সেইসঙ্গে সমানুপাতিক হারে কমেছে প্রতিমার উচ্চতা আর ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কে বেড়েছে শিল্পীদের দুরবস্থা ও দুশ্চিন্তা।কলকাতা সহ বিভিন্ন শহরে বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে পুজো মণ্ডপে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলতে বিশাল আকারের ও উচ্চতার মূর্তির বায়না দিত শিল্পীদের। প্রতিমার উচ্চতা কোথাও ৮০ ফুট কোথাও বা তার কাছাকাছি। দেখা গেছে দুর্গাপ্রতিমার উচ্চতার প্রতিযোগিতা। এটা ছিল পুজো কমিটির কাছে জাঁকজমকের একটা অঙ্গ। আর সেই সুবাদে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক ঘরে তুলতে সেই সব শিল্পীরা। কিন্তু চলতি বছরে সেসব যেন ইতিহাস।

এখন তো করোনাসুরের দখলে সবকিছু। বন্ধ হয়ে গেল যোগাযোগ, কল কারখানা। মানুষ হয়ে গেল গৃহবন্দী। লাটে উঠলো কাজকর্ম। আর্থিক টানাটানি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো যে মূর্তি গড়ার জন্য উপযুক্ত জিনিসপত্র কেনার টাকা জোগাড় করতেই শিল্পীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ওদিকে কিভাবে পুজো হবে, আদৌ পুজো করা যাবে কিনা সেই চিন্তায় পড়েছে পুজো কমিটি গুলি। তাই বড় মূর্তি তো দূরের কথা আগে থেকে কোন মূর্তির বরাতই পাচ্ছিলনা শিল্পীরা। তবুও কর্মহীন গৃহবন্দি থাকার সময়ে শিল্পীরা চেষ্টা করেছিল বেশকিছু মূর্তি তৈরি রাখার। ভাগ্যের এমনই পরিহার মাঝে মাঝেই অকাল বর্ষণে নষ্ট হয়ে গেছে বেশকিছু প্রতিমা। অনেক কষ্টে যতগুলি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল তাদের মধ্যে অনেকগুলি বিক্রি হয়নি। তাই শিল্পীদের আর্থিক অনটন আর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এই অবস্থায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। যে প্রতিমাগুলো বিক্রি হলো তাও উপযুক্ত দামে হ’লনা। যেখানে অন্যান্য বছর এক একটি মূর্তি ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ, দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হতো, মূর্তি পাড়ি জমাতে ভিনদেশেও। সেখানে এবছর সেইসব মূর্তি কুড়ি হাজার টাকা থেকে গড়াতে শুরু করেছে। বিদেশে বিক্রির রাস্তা তো সম্পূর্ণ বন্ধ। বেশি দাম দিয়ে কিনতে চাইছে না পুজো কমিটিগুলি। তারা বলছে আমাদের বাজেট কম। টাকা নেই। কোথা থেকে কিনব? তাই মাথায় হাত বাংলার মাটির শিল্পীদের। একেকটি বড় বড় মূর্তি তৈরি করতেও অনেক খরচ পড়ে যায়। কোথা থেকে জোগাবে সেইসব খরচ? তাই কমেছে মূর্তির উচ্চতা আকার।

তিরোলের প্রতিমা শিল্পী অসিত পাল বলছেন অন্যান্য বছর আগে থেকে ঠাকুর গড়ার বায়না পেতাম। কমিটির লোকেরা বলে দিয়ে যেত তাদের কত বড় মূর্তি লাগবে। বড় বড় প্রতিমা গুলোতে ভালো টাকা আসত। এবছর তেমন কোন খবরই নেই। এই বছর সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। যে দু-তিনটে পুজো মণ্ডপে আমরা বাঁধা কাজ করি তারাও সময় মত আসেনি। একদিন এক কমিটির দু’জন এসে বলল এবছর আমাদের বাজেট কম। তাই অল্পের উপর একটু ছোট করে প্রতিমা বানিয়ে দিতে হবে। আগে তো এমন দু এক জায়গা ছিল যেখানে মণ্ডপে গিয়ে সেখানে কয়েক দিন থেকে কাজ করে দিয়ে আসতে হত।


পারুলের মৃন্ময় মন্ডল বলছেন – এবছর সবকিছুই কম কম। চারটে মূর্তির বায়না এসেছিল কমিটির লোক আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন এবছর আমাদের বাজেট কম। টাকা নেই। তাই একটু কম এর উপর সারতে হবে। আর লকডাউনের পর রং, ডাকের সাজ এসবের দাম আকাশছোঁয়া। তাই আগের তুলনায় অনেক ছোট করে মূর্তি তৈরি করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। আগে থেকে ঠাকুর গড়ে রাখাও বিপদ। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। তাতেই বেশকিছু মূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো কে আবার তৈরি করতে হচ্ছে। খরচ তো থেমে নেই। তাই কি আর করা যায়। ভাগ্য যখন মারে তখন সব দিক থেকেই মারে। যে মানুষগুলোর হাতের কাজ হাজার হাজার মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে থাকে। জনগণ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় বাংলার সেই সব মাটির শিল্পীদের চোখেমুখে গভীর হতাশার ছাপ।

Loading

Leave a Reply