আরামবাগ জেলা রাজ্য

কমেছে মাটির প্রদীপের চাহিদা, কালীপুজোর আগে ম্লান কুমোরপাড়া, বাড়ছে ইলেকট্রিক লাইটের ঝলক

কালীপুজোর আগে সাধারণত কুমোরপাড়ায় এখনই ব্যস্ততার চূড়ান্ত সময় থাকে। সারাদিন ধরে মাটির প্রদীপ, পুতুল, মূর্তি বানানোর কাজ চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে। গলির মুখে, উঠোনে, বাঁশের মাচায় সারি সারি সাজানো থাকে রঙিন প্রদীপ। কিন্তু এবছর সেই চেনা চিত্রের দেখা মিলছে না। কুমোরদের মুখে উৎসবের আনন্দের বদলে এখন চিন্তার ভাঁজ। কমেছে মাটির প্রদীপের চাহিদা, আর সেই জায়গা দখল করছে বাজারে ছড়ানো বিভিন্ন আকৃতির ইলেকট্রিক লাইট।

 

একসময় কালীপুজোর আগে প্রতিটি পরিবারই মাটির প্রদীপ কিনে রাখত। প্রদীপের আলোয় আলোকিত হত উঠোন, ছাদ, জানালা ও ঠাকুরঘর। কিন্তু এখন সেই জায়গা নিচ্ছে রঙিন বাল্ব, চেইন লাইট, এলইডি স্ট্রিপ ও ডিজিটাল আলোকসজ্জা। শহর থেকে গ্রাম সব জায়গাতেই এখন বিদ্যুতের আলোয় সাজে ঘরবাড়ি। এতে মানুষের সুবিধা যেমন বেড়েছে, তেমনি হারাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য আর মাটির গন্ধ।

 

হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া, আরামবাগ, হাওড়ার কুমোরপাড়াগুলিতে এই পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। বহু পুরনো পরিবার, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মাটির প্রদীপ বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁদের অনেকেই এখন অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ চায়ের দোকান খুলছেন, কেউ ছোটখাটো ব্যবসা করছেন। কারণ মাটির প্রদীপে আর সংসার চলে না। একজন প্রবীণ কুমোর বললেন, “আগে একেকটা কালীপুজোর আগে হাজার হাজার প্রদীপ বিক্রি হত। এখন মানুষ বিদ্যুতের আলোয় ঘর সাজায়, আমাদের জিনিস পড়ে থাকে।”

 

এছাড়াও দাম বাড়ায় কাঁচামালের খরচও বেড়েছে। মাটি, রং, তেল, কাঠ, খড় সব কিছুর দাম এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ বিক্রি কমে যাওয়ায় লাভের মুখ দেখছেন না মৃৎশিল্পীরা। তাই কেউ কেউ এবার আর প্রদীপ তৈরিই করছেন না। যাঁরা এখনও করছেন, তাঁদেরও তৈরি করা জিনিস বিক্রি না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে।

 

অন্যদিকে বাজারে ইলেকট্রিক লাইটের রকমারি নতুন নতুন ডিজাইন ও রঙের ছটা গ্রাহকদের আকর্ষণ করছে। দোকানে দেখা মিলছে নানা আকৃতির রঙিন লাইটের ঝাড়, ফুলের মালা, এমনকি দেবী কালী বা লক্ষ্মীর আকারে তৈরি আলোকসজ্জারও। অনেকে আবার অনলাইনে বিদেশি ব্র্যান্ডের লাইট অর্ডার করছেন। ফলে ঐতিহ্যবাহী প্রদীপের জায়গা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।

 

তবে কিছু মানুষ এখনও ঐতিহ্যের টানেই মাটির প্রদীপ কিনে রাখছেন। তাঁদের মতে, “ইলেকট্রিক লাইট ঘর সাজায়, কিন্তু প্রদীপের আলোয় যে শান্তি, তা অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না।” তবুও সংখ্যায় সেই ক্রেতারা খুবই কম। ফলে কুমোরপাড়ার ব্যস্ততা এখন আর আগের মতো নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলা চাকের ঘূর্ণি থেমে আছে অনেক বাড়িতে।

 

কালীপুজো যতই কাছে আসছে, ততই ম্লান হয়ে পড়ছে কুমোরদের মুখ। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত শহর-গ্রাম যত উজ্জ্বল হচ্ছে, ততই নিভে যাচ্ছে মাটির প্রদীপের শিখা। এই পরিবর্তনের ভেতরেই হারিয়ে যাচ্ছে এক টুকরো ঐতিহ্য, এক টুকরো পরিশ্রমের ইতিহাস। কুমোরদের আশা, মানুষ একদিন আবার ফিরবে মাটির গন্ধের টানে, প্রদীপের কোমল আলোর কাছে যা শুধু আলো দেয় না, হৃদয়ের উষ্ণতাও ছড়িয়ে দেয়।

Loading

Leave a Reply