সাহিত্য

“ভূতের চার”

গোপাল মিস্ত্রি

[শুরু হল পুজো স্পেশাল গল্প। লিখেছেন গোপাল মিস্ত্রি। আজ প্রথম কিস্তি। ফি সপ্তাহে চোখ রাখুন …আজ বাংলার সাহিত্যের পাতায়।]

গোপাল মিস্ত্রি

বড়সড় লাটাইটা হাতে দিয়ে ভালোদাদু বলল, ‘এটা ঘরে রেখে আয়।’
খালি লাটাই! তাতে সুতোটুতো কিছু নেই! আমার খুব অবাক লাগল, ‘খালি লটাই কী হবে ভালোদাদু?’
-‘এখন রেখে দে, সময় হলেই ভরতি করে দেব।’ একটু গম্ভীরভাবেই বলল ভালোদাদু।
আর কিছু বললাম না। ভালোদাদু যখন বলেছে তখন ঠিক সুতো এনে দেবে। তারপর তাতে মাঞ্জা দেব। আমিও খানিকটা ভাঙা কাচ জোগাড় করে এনেছি সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি ওড়াব বলে।
ভালোদাদু বলল, ‘তবে এই লাটাইয়ে মাঞ্জা সুতো থাকবে না, বুঝলি।’
লাটাইয়ে মাঞ্জা সুতো থাকবে না? তাহলে কি নৌকোর কাছি থাকবে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি আমাকে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য লাটাইটা দাওনি ভালোদাদু?’
-‘না বুদ্ধুবাবু, এটা অন্য কাজে লাগবে। আজ রাতে আমরা এক জায়গায় যাবো। এখন কাউকে কিছু বলিস না। আর শোন, দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর লাটাইটা নিয়ে তুই আর ভুতুম আমার ঘরে আসবি।’ আমার হাতে লাটাইটা দিয়েই দাদু সাইকেল নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।
আমার ভালো লাগল না। ভালোদাদু একটা লাটাই দিল অথচ মাঞ্জা সুতো দেবে না। তাহলে ঘুড়ি ওড়াব কী দিয়ে?
লাটাইটা ঘরে রাখতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। মা জিজ্ঞেস করল, ‘এখন লাটাই দিয়ে কী করবি রে?’
-‘কিছু না মা, ভালোদাদু রাখতে দিল।’
-‘এরপর বুঝি সুতোয় মাঞ্জা দিতে বেরবি? আমি কিন্তু ডাকতে পারব না। দুপুরের আগেই ঘরে ফিরবি। এখানে এলে তো তোর ডানা গজায়।’
-‘মা তুমি না..’
-‘কী আমি বল? কলকাতায় তো স্কুল ছাড়া ঘরের বাইরে পা রাখিস না। আর এখানে যেন ঘরে পা ঢোকে না। ’
মা ঠিকই বলেছে। কলকাতা আমার কেন যেন একটুও ভালো লাগে না। আমার স্কুলের বন্ধুরা কেউ গ্রামে আসার কথা ভাবতেই পারে না। আর আমার ঠিক উলটো। আমার সব সময় যেন মনটা পড়ে থাকে এখানে। এখানে কত লোক। আর কলকাতায় আমি একা। আমার যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। আসলে গ্রামের বাড়িতে মজাই আলাদা। এখানে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানো যায়। রোজই অনুষ্ঠান বাড়ির মতো একসঙ্গে সবাই খেতে বসি। আর অবশ্যই ভালোদাদু। আমি বললাম, ‘না মা। সুতোয় মাঞ্জাটাঞ্জা কিছু নয়। ভালোদাদু এমনিই আমাকে রাখতে দিল।’
-‘তোর ভালোদাদু এমনিই রাখতে দিল? সে এমনি কিছু করার মানুষ? দ্যাখ আবার কী প্ল্যান ভেজে বসে আছে।’
-‘সে আমি জানি না।’
মা আর কিছু বলল না। আমি লাটাইটা রেখে দিলাম। কিন্তু আমারও মনের মধ্যে খালি একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। লাটাই আছে সুতো নেই, এই লাটাই দিয়ে কী হবে?
ভালোদাদু আমার কাছে বেশ রহস্যের চরিত্র। যা সব কাণ্ড করে তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। এই তো কিছুদিন আগে ফাঁদ পেতে একটা ছিঁচকে চোর ধরেছে। শুনেছি লোকে ফাঁদ পেতে পাখি ধরে, বনের জন্তু জানোয়ারও ধরে। কিন্তু চোর ধরে জানতাম না। গ্রামেও নাকি সবাই তা নিয়ে খুব হইচই করেছিল। তারপর সেই চোরটাকে আচ্ছাসে ঠ্যাঙানিও দিয়েছিল। অবশ্য ভালোদাদুই তাকে সাবধান করে ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর নাকি সে আর এপাড়ায় চুরি করতে আসেইনি।

Sponsor Ad

ভালোদাদু আমার বাবার ছোট কাকা। আমরা ভালোদাদু বলে ডাকি। পরানপুর গ্রামে আমাদের সবাই একবাড়িতে থাকে। শুধু আমি বাবা আর মা কলকাতায় বাগুইহাটিতে থাকি। বাবা কলকাতায় চাকরি করে। আমাদের লম্বা বারান্দাওয়ালা দোতলা বাড়িটা খুব পুরনো। শুনেছি দাদুর দাদু নাকি বাড়ি তৈরি করেছিল। এখন বাড়িটার দেওয়ালে কোনও রং নেই। চারধারের দেওয়ালে কোথাও কালো হয়ে যাওয়া প্লাস্টার আছে, কোথাও পুরনো ইট বেরিয়ে আছে। তাতে গাছ গজিয়েছে। বাড়িতে চার দাদু, ভালোদাদু বিয়ে করেনি বলে তিন ঠাকুমা, আমরা ভাইবোন, সব মিলিয়ে অনেক লোক। তাই আমাদের গ্রামের বাড়িটা বেশ জমজমাট।
তবে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাব এই ভালোদাদুর সঙ্গেই। বয়স পঞ্চাশের কম। ভালোদাদু পরাণপুর গ্রামের হাইস্কুলের গেম টিচার। প্রতিদিন ব্যায়াম করে। এখনও রোজ ফুটবল খেলে। ভুতুমকে নিয়ে যায়। আমি বাড়িতে এলে আমিও যাই। আমি এবার ক্লাস এইটে উঠব। কাকার ছেলে ভুতুম ক্লাস সেভেনে উঠবে। ভালোদাদু আমাদের খুব প্রশ্রয় দেয়। আমাকে বুদ্ধু আর ওকে ভুতুম বলে ডাকে ভালোদাদুই। আমার একটা ভালো নাম আছে। অনিন্দ্য। মা বাবা অনি বলে ডাকে। ভুতুমের ভালো নাম আশিস। স্কুলের পরীক্ষা শেষ, তাই গ্রামের বাড়িতে এসেছি।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছে তখনই আমি আর ভুতুম দোতলার একেবারে কোণে ভালোদাদুর ঘরে চলে এলাম। এসে দেখি ভালোদাদু কাকাবাবুর বই পড়ছে। আমরা ঘরে ঢুকতেই বইখানা বন্ধ করে বলল, ‘শোন আজ রাতে আমরা ঘোষেদের বাঁশবাগানে যাব, বুঝলি। তোদের ভয় করবে না তো?’
আমি একটু কেঁপে উঠলাম। জি টি রোড ছেড়ে পরানপুর গ্রামে আসার পথে একটা বড় বাঁশবাগান আছে। ওটাই ঘোষেদের বাঁশবাগান। একপাশে ছোট নদী। পাড়েই শ্মশান। সেখানে গ্রামের লোকেরা মৃতদেহ দাহ করতে নিয়ে যায়। বাঁশবাগানের মাঝখান দিয়ে গ্রামে আসার রাস্তা। ওই বাঁশবাগানে নাকি ভুত আছে। অনেকেই নাকি ভুতের পাল্লায় পড়েছে। একটু রাত বাড়লেই ভুতের উপদ্রব বাড়ে। গ্রামে ইলেকট্রিক থাকলেও ওখানে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে। গ্রামে আসার সময় তো ওই পথ দিয়েই আসতে হয়। তবে শুনেছি সারাদিনে ওখানে কোনও ভয় নেই। ভূতের উৎপাত শুরু হয় রাতে। ভালোদাদু রাতে সেই বাগানে যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন গো ভালোদাদু, রাতে ওই বাঁশবাগানে কেন যাবে?’
নির্লিপ্তভাবে ভালোদাদু বলল, ‘ভূত ধরতে।’
আমি আর ভুতুম দু’জনেই চমকে উঠলাম। ভুতুম বলল, ‘ওখানে সত্যি ভূত আছে নাকি ভালোদাদু।’
-‘আছে তো। কিন্তু ভয় পাস না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু লাটাই দিয়ে কী করবে?’
-‘এনেছিস লাটাইটা?’
-‘না।’
-‘যা নিয়ে আয়।’ বলে ভালোদাদু তাক থেকে নাইলনের খয়েরি রঙের একটা রোল বের করল। তা ঘুড়ি ওড়ানোর সুতো নয়। সুতলি দড়ির মতো মোটা। আমাকে লাটাইটা দিয়ে ভালোদাদু মনে হয় বাজারে গিয়েছিল। হয়তো তখনই এনেছে। বলল, ‘এটা ওই লাটাইয়ে গোটাতে হবে।’
আমি গিয়ে লাটাইটা নিয়ে এলাম। আমার হাতে রোলটা দিয়ে ভালো‌দাদু বলল, ‘নে দু’জনে মিলে লাটাইয়ে গুটিয়ে ফেল। সেবার ফাঁদ পেতে চোর ধরেছিলাম জানিস তো? এবার ভূত ধরব। তোরা কিন্তু আমার সঙ্গে থাকবি না। একটু দূরে একা একা থাকবি। পারবি তো?’
ভুতুম জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, তুমি কোথায় থাকবে ভালোদাদু?’
-‘আমি তোদের থেকে দূরে থাকব। তোরা ভয় পাবি কিনা বল।’
অতবড় বাঁশবাগানে রাতের অন্ধকারে আমি আর ভুতুম থাকব। ভালোদাদু সঙ্গে থাকবে না। এখনই যেন কাঁপুনি দিচ্ছে। আবার নাও বলতে পারছি না। তাহলে ভালোদাদু আমাদের ভীতু ভাববে। আর কাছে ঘেঁসতে দেবে না। তাই মনে জোর এনে বললাম, ‘না না ভালোদাদু, ভয় পাব কেন? তুমি কাছাকাছি থাকবে তো?’
-‘তাতো থাকবই। নে, গুটিয়ে ফেল। রাতে বেরবো বুঝলি। বাড়িতে কেউ যেন টের না পায়।’ বলে ভালোদাদু আবার কাকাবাবুর বই পড়ায় মন দিল। আমি আর ভুতুম লাটাইয়ে দড়িটা গোটাতে শুরু করলাম।

গ্রামেও এখন ইলেকট্রিক লাইট আছে। তাই সন্ধে হতেই ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। তবে বাগুইহাটির মতো রাস্তায় কোনও আলো নেই। বাড়ি থেকে ঠিকরে যেটুকু আসে। কোনও কোনও বাড়িতে তো বাইরে কোনও আলোই দেয় না। ফলে বেশ অন্ধকার চারদিক। গরমকালে তবু এসময় বাইরে লোকজন থাকে। এখন শীতকাল বলে বাইরে লোকজনের চলাচল নেই।

আমরা বাড়ির ছোটরা মিলে সন্ধের পর থেকে গুলতানি দিয়ে কাটিয়েছি। ভালোদাদু বিকেলে যেন কোথায় বেরিয়েছিল। সে ফিরেও এসেছে।
রাত সাড়ে নটা নাগাদ ভালোদাদু, আমি আর ভুতুম চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে লাটাইটা। গ্রামটা শেষ হওয়ার পর অনেকটা দূরে সেই বাঁশবাগান। তারপর আরও খানিকটা মাঠের পর জি টি রোড। সারাদিন এই রাস্তায় প্রচুর লোক চলাচল করলেও এখন একেবারে নিস্তব্ধ। চারদিক অন্ধকার।
ভালোদাদু বলেছিল, ‘কথা বলবি না। আমরা যে এদিকে যাচ্ছি তা যেন কেউ টের না পায়।’ তাই টর্চটা জ্বালছে না। আমরা চুপচাপ বাঁশবাগানে ঢোকার মুখে এসে থামলাম। রাতে বাগানটা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়েই গা ছম ছম করছে। ভালোদাদু নিচু গলায় বলল, ‘ভয় পাস না।’
ভুতুম বলল, ‘এই বাগানেই তো সত্যি ভূত আছে, না ভালোদাদু?’
ভালোদাদু ফিস ফিস করে বলেল, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ ভুতুমবাবু?’
ভুতুম শুকনো গলায় বলল, ‘একটু একটু করছে।’
-‘ভয় পেও না। কথা বলবে না। আচ্ছা শোন, তোরা এখানে চুপটি করে বসে থাক। আমাকে লাটাইয়ের দড়ির মাথাটা দে। আমি দড়িটা নিয়ে চলে যাচ্ছি। তোরা এইখানে লাটাই নিয়ে থাকবি। মনে কর মাছ ধরতে ছিপ ফেলেছিস। আমি যখন ইশারা করব তখন আমার কাছে আসবি।’
-‘কী করে ইশারা করবে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-‘এই দড়িটায় যখন টান পড়বে তখন বুঝবি আমি তোদের ডাকছি। তোরা তখন বাঁশবাগানে ঢুকবি।’
ভালোদাদু আর কিছু না বলে দড়ির মাথাটা ধরে বাঁশবাগানের ভেতরে ঢুকে গেল।
ভুতুম ফিসফিস করে বলল, ‘দাদা, ভালোদাদু কী করবে কিছু বুঝতে পারছিস?’
আমি বললাম, ‘ না।’
আমরা চুপ করে ছোট একটা ঝোপের আড়ালে বসে আছি। মশা কামড়াচ্ছে। চারদিকে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। এই বাঁশাবাগানে ভূত আছে। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ কীসের যেন শব্দ হল। প্রথমটায় ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দ। তারপর খস খস আওয়াজ। আর তারপরই হিঁহিঁ হাসি। আবার সরু গলায় বেশ জোরে হাসির শব্দ। ভয়ে কেঁপে উঠলাম আমরা। শব্দগুলো যেন ক্রমশ বাড়ছে। কখনও কাছে আবার কখনও একটু দূর থেকে আসছে। হঠাৎ যেন একটা শেয়ালও ডেকে উঠল নদীর পাড়ের দিক থেকে। তারপর আবার একটা। আবার জোরে কোনও কিছুর দাপাদাপির শব্দ। জঙ্গলের মধ্যে একটা আলো জ্বলছে আর নিভছে। একবার এদিকে এগিয়ে আসছে আবার সরে যাচ্ছে। আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ে হাত পা যেন আরও ঠান্ডা হচ্ছে। কিন্তু ভালোদাদুকে ডাকার উপায় নেই। হঠাৎ ভুতুম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘দাদা দ্যাখ।’

Sponsor Ad

দেখি অন্ধকারের মধ্যে কিছু যেন জ্বল জ্বল করছে। জ্বলন্ত দু’টো গোলা যেন এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। ওটা নির্ঘাৎ ভূত। এই বুঝি আমাদের ধরে ফেলবে। তারপর ঘাড় মটকে দেবে। আমারও গলা কাঁপছে। ভুতুমকে জড়িয়ে ধরলাম। ভুতটা এসে যদি এবার আমাদের ঘাড় মটকে দেয় তবে কী হবে? দাদু কাছে নেই। ফিসফিস করে বললাম, ‘চোখ বন্ধ কর।’ দু’জনে চোখ বন্ধ করে জড়াজড়ি করে বসে রইলাম। হাতের লাটাই পড়ে গেল।
এবার কী হবে? লাটাইটা খুঁজতেও পারছি না। তবে দড়িটা আমাদের দু’জনের মাঝখানে আছে। আমরা কেউ আর কথা বলছি না। জড়াজড়ি করে বসে ভয়ে কাঁপছি। সময় যেন আর কাটছে না। ভালোদাদুও ইশারা করছে না। তাহলে কি কিছু হল? ভূত যদি ভালোদাদুকে ধরে তুলে নিয়ে যায় আর তারপর আমাদের ধরতে আসে? কী করব আমরা?
অনেকক্ষণ পর মনে হল যেন দড়িতে টান পড়ল। আমাদের দু’জনের বুক ঘষে দড়িটা জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। মানে ভালোদাদু টানছে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমি ভুতুমকে বললাম, লাটাইটা খোঁজ। আমি দু’হাতে দড়িটা ধরে থাকলাম। হাতের মাঝখান দিয়ে দড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। ভুতুম লাটাইটা কুড়িয়ে ও ঘুড়ি ওড়ানোর মতো ধরে থাকল আর আমি দড়ি ছাড়তে লাগলাম। বেশ খানিকক্ষণ পর ভালোদাদুর গলা শুনতে পেলাম, ‘বুদ্ধু, ভুতুম তোরা এদিকে আয়, ভুত ধরেছি।’
আমরা উঠে দাঁড়ালম। দাদুর গলা যেখন পেয়েছি তখন আর ভয় নেই। এবার ভুত দেখব। লাটাই ফেলেই ছুট লাগালাম। ভালোদাদু আমাদের দিকে টর্চের আলো ধরে আছে। ছুটতে ছুটতে এসে দেখি ভালোদাদুর পায়ের কাছে খুব কালো মতো মোটাসোটা কিছু একটা মাটিতে পড়ে আছে।
ভালোদাদু সেটার দিকে টর্চ ফেলল। দেখি দু’টো লোক একসঙ্গে নাইলনের দড়িটা দিয়ে পেঁচানো। গা মাথা ঢাকা কালো কাপড়ে কঙ্কালের মতো আঁকা। ভালোদাদু ওদের মুখের কাপড় সরিয়ে বলল, ‘এরাই হল ভূত। এরাই এই পথের লোকজনকে ভূতের ভয় দেখায়। নিশ্চয় অপকর্ম করে। সেটা কেউ যাতে টের না পায় তাই এই পথে যারা যাতায়াত করে তাদের ভয় দেখায়। ’

ভালোদাদু মোবাইল বের করে কোথায় কাকে যেন ফোন করে শুধু বলল, ‘আসুন।’ হঠাৎ দেখি দূরে জি টি রোডের দিকে একটা জোরালো আলো জ্বলে উঠল। তা এদিকে এগিয়ে আসছে। বোঝা গেল গাড়ি। গাড়িটা আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। পুলিসের লোক নেমে এল। গাড়ির হেড লাইটের আলোয় দড়ি বাঁধা দু’জনের মুখ দেখে অফিসার চমকে উঠে বললেন, ‘বিশু দাশু তোরা!’
ভালোদাদু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি চেনেন নাকি এদের?’
-‘চিনি মানে? আমার থানায় তো এদের ছবি লটকানো আছে। মোস্ট ওয়ান্টেড ডেকয়েট ব্রাদার। ব্যাটারা আমাকে কম ভুগিয়েছে! তারমানে এখানেই ওদের ডেরা? ওদের দলে আরও ডাকাত আছে। ওরাও জড়ো হতো।’
-‘বলছেন কী বড়বাবু?’
-‘ইন্দ্রনীলবাবু, আপনি আজকে এ তল্লাটের সবচেয়ে কুখ্যাত দুই ডাকাত ভাইকে ধরে দিলেন। ওরাই যে এখানে ভূতের ভয় দেখাচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারিনি।’
ভালোদাদু বলল, ‘আমার বারবার মনে হয়েছিল কেউ ইচ্ছে করে সেজেগুজে ভূতের ভয় দেখাচ্ছে। তাই আর কী, সাহস করে এসেছিলাম ভূত ধরতে। তবে একেবারে ডাকাত ধরে ফেলব বুঝিনি।’
বড়বাবু বললেন, ‘আরে এই সাহসটাই বা কে দেখায়? আপনার সাহায্য মনে রাখব। ধন্যবাদ আপনাকে।’ তারপর দড়ি পেঁচানো দু’জনকে হাতের লাঠিটার খোঁচা দিয়ে বড়বাবু বললেন, ‘তোরা আজ কোথায় ডাকাতি করতি?’
একজন বলল, ‘আজ পরানপুরের রায়বাড়িতেই ডাকাতি করার প্ল্যান ছিল।’
-‘অ্যাঁ?’ আমরা আঁতকে উঠলাম। ভালোদাদু বলল, ‘বলিস কীরে ব্যাটা? শেষকালে আমাদের বাড়িতে?’
বড়বাবু বললেন, ‘চল তোদের আজ ডাকাতি করাচ্ছি।’
বিশু আর দাশুকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বড়বাবু চলে গেলেন। ভালোদাদু বলল, আসলে কী জানিস তো এই শ্মশান আর বাঁশবাগানের ভূতের ভয় পুলিসও পেত। তাই ওরা কোনওদিন ভূত খুঁজতে আসেনি। তাহলে তো আগেই এই ডাকাতদের ধরতে পারত।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুলিস জানল কী করে আমরা এদের ধরেছি?’
ভালোদাদু বলল, ‘আমি বিকেলে থানায় গিয়ে বড়বাবুকে বলে এসেছিলাম বাগানের একটু দূরে অপেক্ষা করতে।’

  • ‘তুমি জানলে কী করে যে ওরাই ভূতের ভয় দেখায়?’
    -‘ওরাই দেখায় তা জানতাম না। কিন্তু মনে হয়েছিল কেউ না কেউ কোনও বদ মতলবে ভূতের ভয় দেখাচ্ছে। তাই তো আমি নিজেই চার হয়েছিলাম। ভূত ধরার চার। জানিস না মাছ ধরতে চার ফেলে, যাতে গন্ধে মাছ আসে। আমিও তাই টর্চের আলো জ্বেলে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলাম যাতে ওরা বুঝতে পারে লোক যাচ্ছে। আর দড়ি লাটাই কেন জানিস? যদি মানুষ হয় দড়িটা দিয়ে বাঁধা যাবে। আর দড়ি টেনেই তোদের সঙ্কেত পাঠাতে পারব। ’

দু’দিন পরে খবরের কাগজে একটা ছোট্ট খবর বেরলো, ভূতের ভয় দেখানো কুখ্যাত ডাকাত ধরে দিলেন দাদু আর দুই নাতি।
শেষ

Loading

Leave a Reply