চড়িদা পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার একটি ছোট গ্রাম। এই গ্রামটি ছৌ- নাচের আঁতুড়ঘর হিসাবে পরিচিত। তারসাথে সাথে গ্রামটি বিখ্যাত হলো মুখোশের জন্য।পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই গ্রামটি বাঘমুন্ডি শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত।এই গ্রামে প্রায় ১০০টি পরিবারের বাস। কয়েক প্রজন্ম ধরে যারা মুখোশ তৈরি করে চলেছে। ছোট থেকে বড় বাড়িতে সার দিয়ে সাজানো শুধুই রং-বেরংয়ের মুখোশ। ছৌ নাচের সাজ সজ্জার প্রধান উপকরণ হলো মুখোশ।আর এই মুখোশ তৈরির জন্যই এই গ্রাম বিখ্যাত। গ্রামের ঢোকার পথে রাস্তার দু’ধারে সারি সারি দোকান। দোকান বললে ভুল হবে এই শিল্পালয় আর এখানে বসেই মুখোশ তৈরির কাজ করে চলেছে শিল্পীরা। তাদের তৈরী মুখোশ শুধু ছৌ নাচের জন্য ব্যবহৃত হয় না। এখন দেশ-দেশান্তরে সুসজ্জিত ডাইনিং রুম আলো করে রাখছে চড়িদার মুখোশ। এখানে দোকানের দাওয়ায় বসেই শিল্পীরা কাজ করে চলেছে, বড়দের সঙ্গে হাত লাগিয়েছি ছোটরাও।কাগজ, কাপড়, মাটির প্রলেপে রঙের তুলি বুলিয়ে মুখোশ কে জীবন্ত করে তুলতে ব্যস্ত তাঁরা।এই গ্রামে যারা ঘুরতে আসেন তারা সফরের স্মৃতি হিসেবে এই মুখোশ সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এর ফলে এখানকার শিল্পীদের আর্থিক সামান্য উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছে এই শিল্পীদের কয়েকজন।
চড়িদা ও ছৌ মুখোশ একে অপরের পরিপূরক। ছৌ নাচের অপরিহার্য উপকরণ হল মুখোশ। যা ছৌ নাচের প্রান।আর এই সব মুখোশের সিংহভাগই তৈরি হয় বাগমুন্ডি পাহাড় চড়িদাগ্রামে। চড়িদার শিল্পী সূত্রধর সম্প্রদায়ের মানুষেরা আগে থাকতেন বর্ধমানে। আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে বাগমুন্ডির রাজা মদন মোহন সিংহ তাদের এই পাহাড় জঙ্গল ঘেরা গ্রামের নিয়ে আসেন রাজবাড়ির প্রতিমা তৈরি করার জন্য। মুখোশ বানানো এই গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দাদের কাজ। বস্তুত এটা একটা পারিবারিক শিল্প। মুখোশ কথাঃ- মুখোশ হলো একটি প্রাণীর মুখের প্রতিরূপ। শুধু প্রতিরূপ নয়, মুখোশে পাওয়া যায় চরিত্রের আভাস। যেমন বাঘের মুখে ফুটে ওঠে হিংস্রতা। দুর্গার মুখোশে অভয়। মানুষের কল্পনা ও শিল্পকলার এক অনন্য প্রকাশই হলো এই মুখোশ। কাঠ, মাটি, শোলা, কাগজ,বাঁশ,কাপড়, রং, আঠা, মুখোশ এর প্রধান উপকরণ। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখোশ নাচ ২০১০ সালে মানবজাতির এক ঐতিহ্যবাহী পরম্পরা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। আর ছৌ মুখোশ এই গৌরবের অংশীদার। চড়িদার মুখোশ শিল্প বাংলার লোকশিল্পে এক অনন্য ঐতিহ্য।মুখোশের ধরনঃ- ছৌ মুখোশকে শিল্পীরা সাধারণত দুই ভাবে ভাগ করেন, ছৌ নাচের মুখোশ ও গৃহসজ্জার মুখোশ। আবার নাচের চরিত্র অনুযায়ী নানা ধরনের মুখোশ তৈরি করেন তারা। যেমন বাবু মুখোশ-এগুলো হল কার্তিক, কৃষ্ণ, গণেশ, শিব প্রভৃতি মুখোশ।বীর মুখোশ গুলি হল- রাবণ,বালি,সুগ্রিভ,মহিষাসুর, তারকাসুর শুম্ভ-নিশুম্ভ প্রভৃতি। পশু মুখোশ গুলি হল- বাঘ,সিংহ,বড়াহ, মহিষ প্রভৃতি এবং পাখি মুখোশ- ময়ূর, বক, জটায়ু প্রভৃতি।নারীমুখোশ হল- দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, সীতা প্রভৃতি। ভূত মুখোশগুলি হলো- শ্মশান অনুচর, নন্দী ভৃঙ্গী প্রভৃতি। মুখোশ তৌরির জন্য যে সমস্ত সরঞ্জাম লাগে তার হলো- ‘থাপি’:- বাঁশ ও কাঠের তৈরি এই জিনিসটা দেখতে অনেকটা কর্ণিকের মত। লম্বায় ১০-২০ সেমি। ছাঁচ বা মডেল তৈরির পর্যায়ে ব্যবহার করা হয় বাঁশের থাপি।
পরে মাটি গোলা জল সহ কাপড় লাগানোর পর পেবড়ো কাঠের থাপি ব্যবহার করা হয়।চিয়াড়িঃ- মুখোশের নাক, চোখ, ঠোঁট ইত্যাদি সঠিক ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় এটি।কাঠের তৌরি এই উপকরণটির দু দিক সরু।তুলিঃ- বিভিন্ন পর্যায়ে খড়ি মাটি ও রং লাগানোর জন্য এবং চোখ মুখ নাক ঠোঁট অলংকরণের জন্য শূন্য থেকে ২৪ পর্যন্ত নানা নম্বরের তুলি ব্যবহার করা হয়। শেডিং ব্রাশ,প্লাস, তার-কাটা,কাটারী,কাঁচি,এবং সুয়া বা ফ্যাচুরা ব্যবহার করা হয়। এক মুখোশ শিল্পী জানালেন, পরিবার সূত্রে তিনি এইকাজে এসেছেন।এই কাজে প্রথমে তাঁর একটুও মন ছিলনা।অভাবের সংসারে এই কাজ করে তাদের সংসার চলছিলোনা।কিন্তু টান যাবে কোথায়। আস্তে আস্তে এই মুখোশ তৌরির কাজ শুরু করে।এই কাজে যে ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছে সে মনে করে এই কাজটাই তার জন্য পারফেক্ট। তিনি এখন নানান রকম জিনিস পত্র দিয়ে মুখোশ তৌরির করছেন।যে সমস্ত মুখোশ তৈরি করেছেন সেগুলি এখন দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে ফলে তাদের অভাব কমেছে এবং খ্যাতি বেড়েছে। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা রকম প্রকল্পে তাদের তৈরি মুখোশ ব্যবহৃত হচ্ছে । ফলে এই মুখোশ তৌরির কাজে তারা উৎসাহ পাচ্ছে।এছাড়াও পর্যটকরা শীতের মরশুমে এসে কেনাকাটা করলে কিছুটা উপকার হয়৷ মাসে হাজার দশেক টাকা এই সময় রোজগার হয়৷ এই টাকা জমিয়ে সারা বছর চালাতে হয় তাদের।তবে মুখোশ শিল্পীরা জানিয়েছেন, শুধু শিল্পের প্রচার হলেই শিল্পী বাঁচে না৷ গ্রাম, শিল্পী ও শিল্প এই তিনটের একটি ইউনিট হিসেবে প্রচার ও প্রসার করতে হবে৷