ফিচার

স্বামীজি ১১ ই সেপ্টেম্বর আমেরিকায় বক্তৃতা দিতে যাওয়ার আগে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। দিনটি ছিল সোমবার। ঘটনাস্থল আমেরিকার শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউট। বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলনের আসর বসেছে সেখানে। বক্তা তালিকায় রয়েছেন খ্রিস্টান, ইসলাম, ইহুদি, ব্রাহ্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিল্টো, জরথ্রুষ্ট, তাও এবং কনফুসিয়াস ধর্মের প্রতিনিধিরা। সবমিলিয়ে দশটি ধর্মের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ওই মহাসম্মেলনে। আর এই কারণেই ঠিক বেলা ১০টায় দশবার ঘন্টা বাজিয়ে শুভ উদ্ধোধন মুহূর্ত ঘোষিত হল। ঘোষণা মুহূর্তে মঞ্চে ছিলেন দশ ধর্মেরই দশজন বক্তা। তাঁদেরই একজন বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। পরণে ছিল লালচে রঙের আঙরাখা, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি। অন্য ন’জন বক্তার থেকে পোশাক, রঙ্গ এবং চোখেমুখে ছিল তাঁর আলাদা এক দীপ্তি। আর সেই কারণেই প্রেক্ষাগৃহে থাকা হাজার পাঁচেক শ্রোতার নজর আলাদা করে বারে বারেই পড়ছিল কলকাতা থেকে যাওয়া এই তেজদীপ্ত পুরুষের দিকে।

মধ্যাহ্নভোজের আগেই চারজন বক্তব্য শেষ করলেন। সবাই আগে থেকে লিখে আনা কথা দেখে দেখে, পড়ে পড়ে সবাইকে শোনালেন। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের অধিবেশনে স্বামীজির বলার পালা এল। তিনি অন্য বক্তাকে বলার সুযোগ দিতে চাইছিলেন। কিন্তু পাশে বসে থাকা ফরাসি ধর্মযাজক ব্রেনেট মারি স্বামীজিকে সুযোগটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। এরপরই সটান মঞ্চের পোডিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সহিষ্ণুতার বার্তা তুলে ধরে উচ্চারন করলেন সেই বিখ্যাত বাক্য।

সভায় উপস্থিত হাজার পাঁচেক শ্রোতাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা’। বাক্য শেষ হতেই করতালিতে গোটা আর্ট ইনস্টিটিউট ফেটে পড়ল। উচ্ছ্বাস-আবেগে ঘেরা শ্রোতাদের সেই হাততালি যেন থামতে চায় না। কেউ কেউ আবার ছুটে গেলেন মঞ্চের সামনে স্বামীজিকে করমর্দন করে অভিনন্দন জানাতে। আমেরিকান তরুণী-যুবতীরাও আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মঞ্চের সামনে গিয়ে হাত নেড়ে সমর্থন জানিয়ে এলেন।

হাততালি থামতেই স্বামীজির হিন্দু ধর্মের নামে সনাতন ধর্মের মূল বার্তা তুলে ধরলেন বিশ্ববাসীর কাছে। জানিয়ে দিলেন, সনাতন ধর্ম মানেই পরধর্ম সহিষ্ণুতা, অন্যকে ভালবাসা এবং সম্মান দেওয়ার অর্থি হল হিন্দু ধর্ম পালন করা। পশ্চিমী বিশ্বের কাছে হিন্দু ধর্ম মানে যে পৌত্তলিকতাবাদের ধারণা ছিল তা মুছে দিলেন তিনি। একইসঙ্গে ধর্মের নামে ক্রুশেড, রক্ত-হানাহানির মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিস্তারকে নিন্দা করে জানিয়ে দিলেন ভারতবর্ষের চিরন্তন ঐতিহ্য ও অতীতের কথা। একের পর এক উদাহরণ তিনি দিয়েছেন, পুরাতন ধ্যান-ধারনা ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছে, আর শ্রোতারা হাততালিতে-উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে দিয়েছে হলঘর।

এভাবে কখন যে এই বক্তব্য শেষের দিকে পৌঁছে গিয়েছে তা অনেকেই সময়ের হিসেব রাখেননি। বস্তত এই কারণেই সেদিন স্বামীজির বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বারে বারে পেক্ষাগৃহের নানা প্রান্ত থেকে আরও বলার জন্য অনুরোধ এসেছে। আবেদন এসেছে, কাতর প্রার্থনা করেছেন শিকাগোর সেই ধর্ম মহাসম্মেলনে হাজির থাকা দেশ-বিদেশের কয়েক হাজার শ্রোতা। স্বামীজি সেদিন বক্তব্য শেষ করেছেন সম্মেলন শুরুর ঘন্টাধ্বনিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। বলেছেন, “আমি সর্বতোভাবে বিশ্বাস করি, আজ এই ধর্ম মহাসম্মেলনে হাজির থাকা দেশ-বিদেশের কয়েক হাজার শ্রোতা। স্বামীজি সেদিন বক্তব্য শেষ করেছেন সম্মেলন শুরুর ঘন্টাধ্বনিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। বলেছেন, “আমি সর্বতোভাবে বিশ্বাস করি, আজ এই ধর্ম মহাসম্মেলনে হাজির বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের সম্মান জানাতে যে ঘন্টাধ্বনি ভেসে এল তা ধর্ম নিয়ে উন্মত্ততার সমাপ্তি ঘটাবে। কলম বা তরোয়াল দিয়ে এতদিন যত নির্যাতন হয়েছে, তারও শেষ হল। আশা করি আমরা সকলে একত্রিতভাবে, ভাইয়ের মতো সবাই যাবতীয় বাধা অতিক্রম করে গোটা বিশ্বে ভ্রাতৃত্বের পথ দেখাবো।’’ কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের যে হর্ষধ্বনি শোনা গেল, তাতে মনে হবে মহাসমুদ্রের কুপিত-গর্জন।

পরদিন আমেরিকার সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছিলেন কলকাতার সিমলা স্ট্রিটের নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের ছবির পাশাপাশি আমেরিকার সবাইকে ‘আমার ভাইবোন’ সম্বোধন করে শুরু করা বক্তৃতা ঘিরে উচ্ছ্বাস ও আবেগ প্রতিফলিত হয়েছিল প্রতিটি সংবাদের কলমে। পরবর্তীতে সম্পাদকীয়, উত্তর সম্পাদকীয়তেও সকলেই ঠাকুর রামকৃষ্ণের এই শিষ্যের শব্দচায়ন ও বক্তৃতার ভাবগম্ভীর উপস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করে ভারতের সনাতন ধর্মকে কুর্নিশ করেছেন।১২৭ বছর আগে অবশ্য এখনকার মতো যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। ছিল না ইন্টারনেট-ই-মেল বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো পরিষেবা। এখন তো আমেরিকায় কোনও একটি স্কুলে বন্দুকবাজ ঢুকে গুলি চালালে এক মিনিটের মধ্যে কলকাতার সমস্ত টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ শুরু হওয়া যায়। কিন্তু সেদিন স্বামীজির এই বিশ্ববাসীর হৃদয় জয় করার ঐতিহাসিক মুহূর্ত কলকাতার মানুষ জানতে পেরেছিলেন ২৮ দিন পর। বাংলার কুলিন ইংরাজি সংবাদপত্র স্টেটসম্যান কাগজে ১৮৯৩ সালে ৯ নভেম্বর  প্রকাশিত হয়েছিল। তাও আবার আমেরিকার বোস্টন ইভনিং ট্রান্সস্ক্রিপ্ট নামের একটি সংবাদ মাধ্যম থেকে ধার করা। ওই সংবাদ মাধ্যমের তরফে ফ্রান্সিস অ্যালবার্ট ডাউটি নামের একজন শিকাগো ধর্মহাসম্মেলনে হাজির ছিলেন। তাঁরই বর্ণনায় উঠে এসেছিল হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে পাগড়ি পরা সৌম্য দর্শন এক সন্ন্যাসীর হৃদয় জয় করা ভাষণের কথা। শুধু তাই নয়, সেদিন স্টেটসম্যান কাগজে লেখাছিল-বছর তিরিশের ঐ যুবক কলকাতার ছেলে এবং নজরকাড়া চেহারার পাশাপাশি চোখা চোখা শব্দ চয়ন করে মানুষের মন টেনে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে এই সন্ন্যাসীর। ডাউটির লেখায় সেদিন ফুটে উঠেছিল স্বামীজির অসামান্য নান উদাহরণ দিয়ে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত বানী শ্রোতাদের মনে প্রথিত করে দেওয়ার অসীম ক্ষমতার কথা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর আগে সেদিনকার এই সংবাদ নিয়ে কলকাতার অনেকেই খুব একটা গুরুত্ব দেননি। এমনকী, উত্তর কলকাতার সিমলা স্ট্রিটের অনেকে সেদিন জানতেও পারেননি যে তাঁদের পাড়ার ছেলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত শিকাগোয় গিয়ে ধর্ম মহাসম্মেলনে মাত করে দিয়েছেন। যদিও পরে আলম বাজার বরানগর মঠে থাকা নরেন্দ্রনাথের সতীর্থরাও তখন ঠিকঠাক জানতেন না  বিবেকানন্দ কোথায় গিয়েছেন, কোন কাজে গিয়েছেন। শিকাগো থেকে স্বামীজি ফেরার অল্প কিছুদিন আগে অবশ্য তিনি জেনেছিলেন এবং বজবজে জাহাজে করে এসে নামার সময় অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের সংকলক মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ওরফে শ্রীম লিখেছিলেন, আমেরিকা যাত্রার কথা স্বয়ং স্বামীজিই অতি গোপন রাখতে বলেছিলেন। সেদিক দিয়ে আমরা এখন অনেকটাই সৌভাগ্যবান কারণ, স্বামীজির সেদিনের কর্মকান্ড ও পরবর্তী নানা ঘটনা মুহূর্ত জানতে পারছি। কিন্তু তখন ভারতের অন্য প্রদেশের মানুষ তো দূরের কথা, কলকাতার স্বামীজির সতীর্থরাই প্রায় এক মাস পর জেনেছিলেন গুরুভাইয়ের সাফল্যের কাহিনি।

Sponsor Ad

আর এটাই ছিল এক বাঙালির সাগরপাড়ে পা রেখে মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সনাতন ধর্মের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে বিশ্বজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনা। আজও আরও একবার হিন্দুধর্মের অপব্যখ্যা হচ্ছে, সনাতন ধর্মকে রাজনীতির ব্যাবসায়ীরা হাতিয়ার করে গদি বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছে। তাই আরও একবার স্বামীজির সেই শিকাগো বক্তৃতার প্রেক্ষাপট এবং মর্মবাণী মানুষকে মনে করিয়ে দিয়ে বিভেদের রাজনীতি করা মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। তবেই হবে শিকাগো বক্তৃতার ১২৭ বছর পূর্তির প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ ও সম্মান জানানোর কর্মসুচি।

Loading

Leave a Reply