বব দত্তঃএই মুহূর্তে যে বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে ভাবাচ্ছে তা হল করোনার হাত ধরেই কি বিশ্ব থেকে পুঁজিবাদের ধ্বংস ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে? এই প্রশ্ন এই মুহূর্তে অনেকের কাছে বালখিল্য মনে হলেও একটু সচেতনভাবে যদি পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেন তাহলে আপনিও ধীরে ধীরে নিশ্চিত সিদ্ধান্তের দিকে পৌঁছবেন। পুঁজিবাদের মৃত্যু ঘণ্টা কিন্তু বাজচ্ছে। দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক মানচিত্র থেকে শক্তির ভরকেন্দ্র। ক্রমশ সে সরে যাচ্ছে সমাজতন্ত্রের দিকে। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ছে পুঁজিপতি দেশগুলো। কিন্তু দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিচ্ছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি। মনে হচ্ছে এখনই এতটা ভাবার কারণ নেই, তাই তো? চলুন আপনাদের একটু পৃথিবীর মানচিত্রের অংশবিশেষে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি…
মনে করুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক দিনগুলির কথা। মনে করুন হিরোশিমা-নাগাসাকির কথা। মনে করুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ক্রমবর্ধমান হারে আমেরিকার দাদাগিরির কথা। দাদাগিরি এতটাই বেড়েছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা ভেবে নিয়েছে তারা শুধু আমেরিকা নয়, বকলমে শাসন করবে বিশ্বকে। শাসন করবে পৃথিবীর যে প্রান্তে যে দেশে তাদের স্বার্থ আছে, সেই দেশকেই। যেখানে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র আছে, সেখানেই প্রতিনিয়ত নাক গলিয়েছে হোয়াইট হাউস। তা ভারত- পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হোক, ইরাক-ইরানের ক্ষেত্রে হোক, দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রে হোক, সর্বত্রই আমেরিকার দাদাগিরি যেন স্বভাবসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। আমেরিকা চায় পৃথিবীর সমস্ত দেশ তাদের জন্য বাজার খুলে দেবে। যা কিছু ভালো, তার সবেতেই অগ্রাধিকার আমেরিকার। আমেরিকার উদ্বৃত্ত হলে তবেই তাতে অন্য দেশের অধিকার থাকবে। তা না হলে আমেরিকা রক্তচক্ষু দেখাবে। আজ কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেছে। আমেরিকা ধরাশায়ী। আমেরিকা সহ বিশ্বের অধিকাংশ পুঁজিবাদী দেশ ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কি?
পুঁজিবাদী দেশগুলির আর্থসামাজিক পরিকাঠামো সর্বদাই ভঙ্গুর। পুঁজিবাদীদের হাতে হয়তো অনেক অনেক টাকা থাকে, কিন্তু সেই টাকার ভরকেন্দ্র হয় নির্দিষ্ট কয়েকজন মানুষ এবং নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা। স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদ সাধারণ মানুষের কথা ভাবে না। এদের মূল উদ্দেশ্য হয়, কম সময়ে অধিক মুনাফা অর্জন। তার ফল আজ পাচ্ছে আমেরিকা সহ পুঁজিপতি দেশগুলো। তার কারণ পুঁজিবাদ শেখায়, যার হাতে সম্পদ আছে সে সম্পদ আরও অনেকটাই বাড়াবে। তার ফলে অর্থের ভরকেন্দ্র নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে থাকবে। ফলে সে দেশে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। কিন্তু ধনী গরিবের প্রভেদ করোনা করছে না। গোল বেঁধেছে এখানেই। করোনা যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে গিয়েই থাবা বসাচ্ছে। পুঁজিবাদী দেশগুলোর উচিত ছিল গবেষণা, আপৎকালীন খাতে বাজেট বাড়ানো। অথচ তারা স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে আপৎকালীন খাতে প্রতিনিয়ত বাজেট কমিয়েছে। যেমন আমেরিকার আপদকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুদিন আগেই তা অপ্রয়োজনীয় ভেবে ভেঙে দিয়েছেন। যেই কমিটি ভাইরাস ঘটিত রোগ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যের যেকোনও মহামারী দেখা দিলে তার জন্য বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওষুধ আনা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এই সব দায়িত্ব সামলাত। কিন্তু ট্রাম্পের মনে হয়েছে, এখানে অহেতুক অর্থ খরচ হচ্ছে। তাই তিনি সেটিকে বন্ধ করার নির্দেশ দেন। আজ কিন্তু আমেরিকার মানুষ এই সিস্টেমটা উঠিয়ে দেওয়ার জন্য মাথা চাপড়াছে। একটার পর একটা গবেষণাকে উঠিয়ে দিয়েছে পুঁজিপতিবাবুরা। কারণ তাদের মনে হয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় নয়, এমন জিনিসে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি টাকা খরচ করার কোনও মানেই হয় না। তারা রিয়েল এস্টেট বাড়িয়েছে, নগর উন্নয়নের স্বার্থে পরিবেশকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। কিন্তু আজ তারা বুঝছে বাজার অর্থ দিতে পারে, সুখ দিতে পারে, কিন্তু জীবন দিতে পারে না। জীবন দিতে পারে না বলেই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ডলারও তাঁকে নিশ্চিন্ত জীবন দিতে পারেনি। এখানেই পার্থক্য সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদের। আর কিছুদিনের অপেক্ষা। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র আমেরিকা থেকে সরে যাবে রাশিয়া-চীনের দিকে। তার কারণ এই করোনা।
রাশিয়া পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে, চীন পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে, চীন এই ভাইরাস তৈরি করেছে না করেনি তা সম্পূর্ণ একটি আলাদা বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু এই রোগ প্রতিকারের ক্ষেত্রে যেটি অস্বীকার করার উপায় নেই তা হল চীন এবং রাশিয়া তাদের বাৎসরিক বাজেটের একটি বড় অংশ খরচ করে গবেষণা ও স্বাস্থ্যখাতে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের স্বাস্থ্য নয়, দেশের সমস্ত জনগণের স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের বড় অংশ ব্যয় করা হয়। যার ফল, যার ফসল আজ রাশিয়া, চীন ঘরে তুলছে। এরপর মিলিয়ে নেবেন এই পুঁজিবাদী দেশগুলির একটার পর একটা সংস্থার রুগ্ন হয়ে পড়বে, মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের শিল্প পরিস্থিতি। আর কম পয়সায় কিনবে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি। আমেরিকাকে এখন ভারতের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাত পাততে হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিচ্ছেন দেখে নেওয়ার। আসলে ভয় যারা পায় হুঙ্কার তারাই দেয়। আজ তার কাছে মুক্তির কোনও পথ নেই। সেই কারণে বাধ্য হচ্ছেন কখনও ভিক্ষা করতে, কখনও হুঙ্কার দিতে।
আসলে পুঁজিবাদ শেখায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে, আর সেই পরিশ্রম থেকে অধিক মুনাফা অর্জন করে বাজারে গিয়ে তা খরচ করতে। পুঁজিবাদের প্রথম কথা মাঝের কথা এবং শেষ কথাই হল বহুজাতিক। আজ এই বহুজাতিক বন্ধ। একটার পর একটা বহুজাতিক সংস্থা বন্ধ হচ্ছে। এরপর রুগ্ন হতে হতে তার চিরতরে উঠে যাবে। তখন মানুষ এই অধিক আয় করা অর্থ কোথায় খরচ করবে? বাজার যদি না থাকে তাহলে বাজার ধরার ইচ্ছেশক্তি কীভাবে যোগাবে? একসময় শপিংমলের চোখ ধাঁধানো আলোয় সারাবিশ্বের চোখ ঝলসে গিয়েছিল। এই ফাঁদে আমরা ভারতীয়রাও পা দিয়েছি, আমরা বাঙালিরা দিয়েছি, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন আজ মল বন্ধ। এই পুঁজিবাদ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চায়, আর যে যে জায়গাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছিল আজ তার সবকিছুই বন্ধ। মিলিয়ে নেবেন এর অধিকাংশই উঠে যাবে। কিন্তু আপনার পাড়ার মোড়ের মুদির দোকান, আপনার পাড়ার মোড়ে ছোট কাপড়ের দোকানটা আবার আস্তে আস্তে খুলবে। আর এই বহুজাতিক সংস্থা, বহুজাতিক বাজার যত কমবে কত জানবেন আস্তে আস্তে পুঁজিবাদের মৃত্যু ঘণ্টা বাজছে।
আসলে পুঁজিবাদ চায় এমবিএ পাশ করা মানুষদের দিয়ে একটা সরকারকে চালাতে। যারা দেশকে অধিক মুনাফা এনে দেবে। এই মানসিকতা থেকেই দেশের রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থাগুলিকে একের পর এক বেসরকারিকরণ করে দেওয়ার উদ্যোগ। মানুষকে প্রতিনিয়ত বোঝানোর অপচেষ্টা বেসরকারিকরণ করে দিলে তা থেকে অধিক টাকা অর্জন করা যাবে। যা পুঁজিবাদের প্রথম ফাঁদ। এখান থেকেই বিরোধিতায় সমাজতন্ত্রের সূচনা। সমাজতন্ত্র বলে ক্ষমতা থাকবে নিয়ন্ত্রাধীন, ক্ষমতা থাকবে সরকারের হাতে। অর্থাৎ দেশের মানুষের হাতে। কোনও ব্যক্তিবিশেষের হাতে নয়। যতক্ষণ দেশের মানুষের হাতে বা সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকে, ততক্ষণে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা থাকে, কারণ সেখানে অধিক মুনাফার লোভে পরিবেশ, মানুষকে এবং পরিবেশের ভারসাম্যকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয় না। পুঁজিবাদ সর্বদাই বাস্তুতন্ত্র ভেঙে দিয়ে নতুন নতুন যন্ত্র তৈরি করে, যে যন্ত্র থেকে আসে অধিক মুনাফা, আর যে যন্ত্রের তলায় হারিয়ে যায় সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ দেওয়ার প্রবণতা।
একটা কথা আর একবার ভাবুন, জন বরিস থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফ্রান্স থেকে স্পেন, প্রতিটি দেশের হাতে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি ডলার আছে। যারা জীবনের জন্য প্রয়োজনে টাকার থলি আপনার মুখে ছুঁড়ে মারতে পারে। কিন্তু তারা আজ নিঃস্ব, ভিখারি। গাধার পিঠে চিনির বস্তা চাপানোর মতোই আজকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থা। যে আমেরিকা নিজের শত্রুকে শেষ করতে বিশ্বের অপর এক প্রান্তে ড্রোন পাঠাতে পারে, সে সামান্য একটা ছোট ভাইরাসের মোকাবিলা করতে পারছে না? এ আসলে আর কিছু নয়, পুঁজিবাদের কুফল। টাকার নেশায় এরা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছে। আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে যাঁরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁরা ভাবছেন একেবারেই নেহাতই বালখিল্য। তারা আর কিছুদিন অপেক্ষা করুন, মিলিয়ে নেবেন, দেখে নেবেন পুঁজিবাদ আস্তে আস্তে ধ্বংস হবে। কারণ মানুষের হাতে যদি ক্ষমতা না দেওয়া যায়, মানুষের হাতে যদি অর্থ দেওয়া না যায়, ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ যদি না করা যায়, তাহলে পৃথিবী বাঁচবে না। সমাজ বাঁচবে না। মানুষ বাঁচবে না। আজ করোনা তা চোখে আঙুল দিয়ে আপনাকে আবার একবার দেখিয়ে দিল। ঠিক এই জায়গা থেকেই রাশিয়া-চীন আজ করোনার থাবা থেকে বেরিয়ে আসছে আর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা, জার্মানি, স্পেন, ইতালি।