যখন একটু একটু করে বড় হতে শুরু করেছি তখন স্কুলের শিক্ষক মশাইরা, বাড়ির বড়রা রচনা লেখা শেখাতেন। সেখানে বেশ বড় বড় করে লিখতাম জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। এই কোটেশন ব্যবহারের শেষে লেখা হতো “মা” দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে আমাদের জন্ম দিয়েছেন। কত বড় বড় কথা। আজ সকাল থেকেই ফেসবুক খুলে ছেলেদের মায়ের প্রতি প্রেম দেখে সত্যিই মনটা বড় ভালো হয়ে গেল।ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কুল থেকে তাদের বলা হচ্ছে মায়ের সাথে খুনসুটি আর আদরের একখান ছবি পোস্ট করে স্কুলের প্রোফাইলে হ্যাজ ট্যাগ দিয়ে পোষ্ট করতে।অনেকেই মাকে নিয়ে গান পোস্ট করছেন, কবিতা পোস্ট করছেন। সব মিলিয়ে সকাল থেকে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সমস্ত মায়েদের আজ বড় সুখের দিন। সকল মা দেখছেন তার সন্তানরা তাদের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ, কতটা ভালোবাসায় তাদের দেহ মন উথাল পাথাল করে। সত্যি কি তাই? নাকি সমগ্র বিশ্বেই হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মা এক কোণে পড়ে রয়েছেন। তাদের খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। হাজার হাজার মা আজ এই লকডাউন পরিস্থিতিতে আপনি আমি যখন মাদার্স ডে তে গরম ভাত খাচ্ছি তখন তারা মাইলের পর মাইল হাঁটছেন। আর অসংখ্য বাবা-মা এইরকম পরিস্থিতিতে বৃদ্ধাশ্রমে বসে সন্তানের চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন।
আরামবাগ শহরে পৌরসভার উদ্যোগে কয়েক বছর আগেই একটি বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছে। এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ বাবা-মা। সকাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মায়ের প্রতি সন্তানদের অপরিসীম প্রেম দেখে ইচ্ছে জেগেছিল একবার এই বৃদ্ধাশ্রমে ঘুরে আসার।একবার স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে বৃদ্ধ বাবা-মা-রা এখানে ঠিক কেমন আছেন। এখানে থাকা বাবা-মায়েদের নাম লিখে আর তাদের যাতনা বাড়িয়ে কাজ নেই। কিন্তু কয়েকটি ঘটনার কথা পাঠক-পাঠিকাদের সাথে শেয়ার না করেও উপায় নেই। মেদিনীপুরের মাস্টারমশাই অনেক গাধা পিটিয়ে ঘোড়া তৈরি করেছেন। সারা জীবন অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে শিখিয়েছেন জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী….। অথচ মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুর পর মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রীর স্থান হয়েছে আরামবাগের বৃদ্ধাশ্রমে।মাষ্টারমশাই-এর স্ত্রী বলেছেন ছেলে মস্ত বড় চাকরি করে। ছেলে সেল ট্যাক্সের বড় অফিসার। মোটা টাকা মাইনে পায়। দুই মেয়ে। তারা অবশ্য চায় তাদের কাছে গিয়ে থাকুক মা।কিন্তু মাস্টারমশাই স্ত্রীতো। তাই জামাই বাড়িতে গিয়ে থাকবেন না। অন্যদিকে ছেলের বাড়িতেও বোঝা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই শেষ ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রম। বাড়িতে থাকা নাতি নাতনির জন্য মন খারাপ করে তাই মাঝে মাঝে ছেলেকে ফোন করে একবার সকলকে নিয়ে আরামবাগ ঘুরে যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু ছেলে তো মস্ত অফিসার। সময় পান না। অগত্যা নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলেন মা। মা বলছেন সারাদেশে করোনা পরিস্থিতি চলছে, ঈশ্বরের কাছে তার একটাই প্রার্থনা তার ছেলে বৌমা নাতি নাতনি যেন নিরাপদে থাকে। আজ মাতৃদিবস মা বলছেন আমার সন্তানদের যেন মঙ্গলময় প্রভু রক্ষা করেন।
একই অবস্থা আরও এক বৃদ্ধ বৃদ্ধার। স্বামী স্ত্রী বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। ছেলের বাড়িতে স্থান হয়নি। বৃদ্ধ রেলে চাকরি করতেন, এখনো মোটা টাকা পেনশন পান। বাড়িতে থাকতে না পেরে স্ত্রীকে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের উঠেছেন। ছেলের বাড়িতে স্থান হয়নি বলে বৃদ্ধ কিন্তু ছেলের বাড়ি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন নি। নাতিকে সমস্ত টাকা খরচ করে প্যারামেডিকেল পাশ করিয়েছে। নাতি এখন যাদবপুরে চাকরি করে। নাতিকে নিয়ে এক বুক গর্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার। আজ মাদার্স ডে দেখা হয়নি ছেলের সাথে। কথা হয়নি অনেকদিন। তাই মন খারাপ মায়ের। কথায় আছে কুমাতা যদি বা হয় কুপুত্র কখন না। এই ভাবেই অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত বড় অফিসারের মা নীরবে চোখের জল ফেলছেন বৃদ্ধাশ্রমে।হয়ত ছেলেকে ঠিকমতো এই শিক্ষা দেয় নি দশ.. মাস.. দশ.. দিন…। থাক এসব কথা বলে আজকের মাদার্স ডের সেলিব্রেশান নষ্ট করে লাভ নেই। শুধু একটাই প্রার্থনা তোমরা যেখানে যে অবস্থাতেই থাকো মা ভালো থেকো।মা তোমরা ভালো থেকো।