বেলুন তৈরি হয়েছিল উড়োজাহাজ তৈরীর অনেক আগেই। নেপথ্যে ছিলেন কারিগর দুই ভাই জোসেফ মিশেল মোনগোলফিয়া এবং তার আরেক ভাই জাক এতোয়াঁ মোনগোলফিয়া। এই দুই ফরাসি ১৭৮৩ সালে আকাশে বেলুন উড়িয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। মানুষকে সেই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম জীবিত প্রাণী নিয়ে আকাশে উড়লো বেলুন। কারা ছিল সেখানে, জানলে অবাক হবেন একটি ভেড়া, একটি হাঁস এবং একটি মোরগ। সেই বছরই অর্থাৎ ১৭৮৩ সালে মানুষ কাঁধে নিয়ে আকাশে উড়ে গরম বাতাস ভরা বেলুন। পাখিদের চমকে দিয়ে আঠারো শতক ধরে চলতে থাকে এমন নানা বেলুনের প্রদর্শনী। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তারা নির্বিঘ্নে নেমে আসে মাটিতে। কখনো আবার আগুন লেগে ঘর বাড়ি পুড়িয়ে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে দেয়। নানা রকমের কান্ড ভেবে মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছে। কিভাবে বেলুন হয়ে উঠতে পারে আকাশে।
আমাদের বস্তু নয় বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণার সহায়ক এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে আর এক ফরাসি ব্যক্তির নাম যিনি জন্মেছিলেন আজ থেকে ঠিক দুশো বছর আগে ১৮২০ সালে। তার নাম গাসপাট ফেলেক্স ত্যুরনাশোন, তিনি সকলের কাছে অধিক পরিচিত নাদার নামে। এই নাদার একাধারে চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্র সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক এবং অবশ্যই একজন বেলুনিস্ট। নাদারই ১৮৫৮ সালে প্রথমবার আকাশ থেকে ফটো তোলেন বেলুনে চেপে, ঝুঁকে পড়ে নিচে ছড়িয়ে থাকা শহরের ফটো ধরে রাখছেন. ক্যামেরায় ফটো তোলার এই ছবি আবার কাগজ-কলমে ধরে রাখলেন আর এক শিল্পী. যুদ্ধের সময় শোনা যায় পায়রার পায়ে ক্যামেরায় তোলা ফটো দিয়ে ছবি তুলে জানা যেত বিপক্ষ দলের হানার চেহারা। বেলুনের উপড় থেকে তোলা ছবি নষ্ট হয়ে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু তার অন্যান্য ফটো বিশেষ করে বিখ্যাত ব্যক্তির প্রতিকৃতি ইতিহাসের অন্যান্য সম্পদ। বেলুন সংক্রান্ত সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন নাদার। ১৮৬৩ সালে বেলুনিস্ট ইউজিন গোদারকে নাদার বরাত দিলেন এক পেল্লায় বেলুন বানানোর। তৈরিও হলো বেলুন। সেটি লম্বায় কত ছিল জানলে অবাক হবেন। ৬০ মিটার বা ১৯৬ ফিট উঁচু, আর তার দুটি তলা ৬ খানা ঘর। এমন একটি বেলুনের নাম যে ‘ দ্য জায়ান্ট’ রাখা হবে তার আশ্চর্য্যর কিছুই নেই। কিন্তু এই বেলুনেট পরিণতি অনেকটা টাইটানিক জাহাজের মত হল। দুবার আকাশে ওড়া সত্বেও শেষমেষ মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। আর ভিতরে লোকজনরা এবং নাদার নিজেই লিখেছিলেন সব ছিটকে পড়ে আপেলের মত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বেলুনের ওরা দেখেই লিখে ফেলেছিলেন ফাইভ উইকস ইনঅ্যা বেলুন উপন্যাসটি। ১৮৩৬ সালে এই কলকাতা থেকেই ডি রবার্টসন নামে এক ভদ্রলোক বেলুন উড়িয়ে ছিলেন আকাশে।
তারপর বেশ কয়েক বছর বিরতির পর ১৮৮০ দশকে বিখ্যাত বেলুনিস্ট পার্ভাল স্পেনার ভারতে আসেন এবং সারা দেশেই বেলুনের প্রদর্শনী করতে থাকেন। সেই সময় আকাশচারী এই যানটিকে দেখতে যে কত লোক ভিড় করত তার ইয়ত্তা নেই, কারণ এমন কিছু তো তার আগে কখনো দেখিনি কলকাতার মানুষ ১৮৮৯ সালের ১৯ মার্চ হাইড্রোজেন ভরাবেলুন কলকাতার ঘোড়দৌড়ের মাঠ থেকে আকাশে ওড়ে। মাসখানেক পর আবার উঠলেন তিনি, এবার তাঁর সঙ্গেই ছিলেন রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রামচন্দ্র অসাধারণ শিল্পী। নবগোপাল মিত্রের ন্যাশানাল সার্কাসের খেলুড়ে, পরে গ্রেট ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান সার্কাসের ডিরেক্টরও হন। বেলুন স্পেনসারেট সঙ্গে আকাশে পাড়ি দেওয়ার পর রামচন্দ্র ঠিক করলেন একাই উড়বেন, সেইমতই কেনাহল বেলুন। নাম দিলন’ দ্যা সিটি অফ ক্যালকাটা ‘ এবং ১৮৮৯ এর মে মাসে বিকেল পাঁচটার পর ৮ হাজার মানুষের বিস্ফারিত চোখের সামনে বেলুনে চেপে শুন্যে উঠে গেলেন রামচন্দ্র। প্রায় ৪০ মিনিট ভেসে থাকার পর নেমে এলেন ধীরেসুস্থে। ইতিহাস তৈরি হলো ভারতে। কল্পনার জগত ছাড়িয়ে বেলুনে চড়ে ঘুরে বেড়ালেন মানুষ।